মন যন্ত্র নষ্ট হলেও বিপরীতমুখী ব্যাপারগুলো দেখা যায়। পাশাপাশি দুটি নদী। একটি অন্যটির গায়ের ওপর দিয়ে বইছে। একটির পানি যাচ্ছে সাগরের দিকে। অন্যটির পানি সাগর থেকে উঠে রওনা হয়েছে পর্বতমালার দিকে।
নবনীর মনে কি এরকম দু’টি ধারা বইছে? সে দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে কেন? আনিস কি তার জীবনে বড় ধরনের কোনো আশা ভঙ্গের’ ব্যাপার ঘটিয়েছে?
নবনীর ব্যাপারে আনিসের মনে আশা ভঙ্গের কিছু ঘটে নি। সে জানে নবনী চমৎকার একটি মেয়ে। তার একটাই সমস্যা – সে ভয়াবহ নিঃসঙ্গ। আনিস সেই নিঃসঙ্গতা দূর করতে পারে নি। বিরাটনগর ছেড়ে সে যদি ঢাকায় গিয়ে নবনীর সঙ্গে বাস করতেও থাকে তাতেও নবনীর নিঃসঙ্গতা দূর হবে না। কিছু কিছু মানুষ বিচিত্র ধরনের নিঃসঙ্গতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। কারোর সাধ্য নেই সেই নিঃসঙ্গতা দূর করে। সেই সব মানুষরা তাদের নিঃসঙ্গতা দূর করার চেষ্টা নিজেরাই করে। তা করতে গিয়ে কেউ বড় লেখক হয়, কেউ হয় চিত্রকর, বিজ্ঞানী। আবার কেউ কেউ হয়তো তার মতো ডাক্তার হয়। চারপাশের মানুষদের নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত থেকে নিজের নিঃসঙ্গতা ভুলে থাকতে চায়।
আনিস নবনীর নিঃসঙ্গতা জানে। নবনী কি আনিসের নিঃসঙ্গতা জানে?
দরজায় শব্দ হচ্ছে। ভয়ে ভয়ে কেউ একজন কড়া নাড়ছে। কড়া নাড়ার শব্দ থেকে মনে হয়। সুজাত ফিরে এসেছে। আনিস উঠে দরজা খুলল।
সুজাত মিয়া না, মতি দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে নতুন শার্ট, নতুন লুঙ্গি। পায়ে নতুন রাবারের জুতা। যে ছাতা হাতে সে দাঁড়িয়ে আছে ছাতাটাও নতুন। আনিসের সাইকেল বিক্রি করে সে ভালো দাম পেয়েছে। আট শ’ টাকা। আট শ’র মধ্যে ছয় শ’ নগদ পেয়েছে। দুশ’ টাকা এখনো বাকি আছে। বাকি দু’শ’ টাকা আদায় করতে কষ্ট হবে। শেষ পর্যন্ত আদায় হয় কি-না সেই বিষয়েও তার ক্ষীণ সন্দেহ আছে। মতির খরচের হাত ভালো। ছয় শ’ টাকার প্রায় সবটাই একদিনে শেষ হয়েছে। নিজের জামা-কাপড় ছাড়াও সে দুটা টাঙ্গাইলের তীতের শাড়ি কিনেছে। একটা মর্জিনার জন্যে, আরেকটা বাতাসীর জন্যে।
বাতাসী মেয়েটা বাজারে নতুন এসেছে। বাতাসীর গলার স্বর অতি মধুর। এমন মধুর স্বরে সে এর আগে কোনো মেয়েকে কথা বলতে শোনে নি। বাতাসীর আরো একটি ব্যাপারে সে মুগ্ধ। সেটা হলো বাতাসীর গায়ের গন্ধ। অবিকল তেজপাতার গন্ধ। মানুষের গায়ে নানা রকম গন্ধ থাকে। তেজপাতার গন্ধও যে থাকে। এটা সে কল্পনাও করে নি। মর্জিনার গায়ের গন্ধ টিকটক। খারাপ না। টক গন্ধও ভালো লাগে। তবে তেজপাতার গন্ধ অন্য জিনিস।
মতি বাতাসীর কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছে বিরাটনগর হাই স্কুলের শিক্ষক। এতে কয়েকটা উপকার হয়েছে। বাতাসী তাকে আলাদা খাতির করছে। ‘স্যার’ ডাকছে। মতির দিক দিয়ে সামান্য সমস্যা হচ্ছে–কথাবার্তা শিক্ষকদের মতো বলতে হচ্ছে। শুদ্ধ ভাষা বলতে হচ্ছে। মতি এখন সরাসরি বাতাসীর কাছ থেকে এসেছে। শাড়ি দিতে গিয়েছিল। ইচ্ছা ছিল রাতটা থেকে যাবে। বাতাসী অন্য মানুষ ঘরে নিয়ে নিয়েছে বলে সেটা সম্ভব হয় নি। তবে খুব আফসোস করেছে। দুঃখ দুঃখ গলায় বলেছে–আপনে আইজ আসবেন আগে কইবেন না? মতি বলেছে–আগে থেকে কিছু বলা যায় না। মন উদাস হইলেই শুধু তোমার কাছে আসি। মানুষের মন কখন উদাস হইব কখন হইব। না এইটা বলা বেজায় কঠিন। মানুষের মন তো কঁঠাল না যে জ্যৈষ্ঠ মাসে পাকব। মানুষের মন যে-কোনো সময় পাকতে পারে।
বাতাসী মুগ্ধ গলায় বলেছে–ইস্! আপনি এত সুন্দর কইরা ক্যামনে কথা কন?
মতি বলেছে, আমরা শিক্ষক মানুষ, আমরার কথার এইটাই ধারা। এই নাও শাড়ি। রঙ পছন্দ হইছে?
বাতাসী হতভম্ব গলায় বলেছে–আমার জন্যে শাড়ি আনছেন? কী আচানক কথা! আফনে মানুষটা অত ভালা কেন হইছেন?
বাতাসীর আনন্দ এবং বিস্ময় দেখে মতির বড় ভালো লেগেছে। মর্জিনার ভেতর এই জিনিস নেই। সে আনন্দিতও হয় না, বিক্ষিত্রতও হয় না। শুধু খাবার দেখলে তার চোখ চকচক করে। একটা শাড়ি পেলে সে যত খুশি হয় তারচে’ অনেক বেশি খুশি হয় আধা কেজি গরম জিলাপি পেলে।
আনিস বলল, মতি কী খবর?
মতি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, খবর মাশাল্লাহ ভালো। কয়েক দিন বাইরে কাজকর্মে ছিলাম। গৌরীপুর গিয়েছিলাম। আইজ সন্ধ্যায় ফিরছি। ইষ্টিশনে নাইমা শুনলাম। আপনার সাইকেল চুরি গেছে। মনটা এমন খারাপ হইছে! ভাবলাম দেখা কইরা যাই।
আনিস ক্লান্ত গলায় বলল, আমার সাইকেল চুরির খবর কি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে?
কী বলেন–এইটা একটা ঘটনা না? তবে চিন্তা কইরেন না–গৌরীপুরের এক পীর সাহেব আছেন, চাউল পড়া দেন। সেই চাউল পড়া খাওয়াইয়া দিয়া সাইকেল চোর বাইর করা এক ঘণ্টার মামলা।
চাল পড়া দিয়ে সাইকেল চোর ধরা যায়?
অবশ্যই। পীর সাহেবের চাউল পড়া খাইয়া যদি কেউ মিথ্যা কথা বলে–সাথে সাথে রক্তবমি। আমার নিজের চউক্ষে দেখা।
আনিস বলল, তুমি কি বসবে না চলে যাবে? আমার শরীরটা ভালো না। আমি শুয়ে পড়ব।
আপনার যদি অসুবিধা না হয় দুই চাইর মিনিট বসি। আপনার এইখান থাইকা যাব ইমাম সাহেবের কাছে। উনি চাইলা যাবেন–দেখা কইরা আসি। যত খারাপ লোকই হউক এতদিন মানুষটা গ্রামে ছিল। তার পেছনে কয়েকবার নামাজও পড়েছি। ডাক্তার সাহেবের কি শরীর বেশি খারাপ?
মনে হয় বেশিই খারাপ। কেঁপে জ্বর আসছে।
মতি হাই তুলতে তুলতে বলল, আমরার ইমাম সাহেবেরও শুনেছি বেজায় জ্বর। জ্বরের মধ্যে উল্টা পাল্টা কথা বলতেছে। আপনার কাছে কেউ খবর নিয়া আসে নাই?