রাত আটটার মতো বাজে। আনিস বিছানায় শুয়ে আছে। বিকেল থেকেই তার গা ম্যাজ ম্যাজ করছিল, এখন শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। ডাক্তাররা নিজেদের অসুখ বিসুখের ব্যাপারে উদাসীন হয়। আনিস তার ব্যতিক্রম না। থার্মোমিটারে সে জ্বর দেখে নি। দুটা এনালজেসিক ট্যাবলেট খেয়ে জ্বর কমানোর চেষ্টাও করে নি। হাত পা এলিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তার সামান্য দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে রাতের খাবার নিয়ে। তার রান্না বান্না করে দেয়। সুজাত মিয়া। বয়স দশ এগারো। তার পায়ে সমস্যা আছে। একটা পা বড়, একটা ছোট। হাঁটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। পরশু সকাল থেকে সুজাত নিখোঁজ। কোথায় গেছে কাউকে কিছু বলে যায় নি। ছেলেটি অতি ভদ্র, অতি বিনয়ী, কাজ কর্মে দক্ষ। তার একটাই সমস্যা–মাঝে মাঝে কাউকে কিছু না বলে নিখোঁজ হয়ে যায়। আবার ফিরে এসে কাজকর্ম শুরু করে দেয়। ভাবটা এ রকম যেন কিছুই হয় নি। সে কোথাও যায় নি। এখানেই ছিল।
আনিসের ঘরে হারিকেন জ্বলছে। বিরাটনগরে পল্লী বিদ্যুৎ এসেছে। ডাক্তারের কোয়ার্টারে পল্লী বিদ্যুতের লাইন আছে। ইলেকট্রিকের তারে কী সমস্যা হয়েছে–বাতি জ্বলছে না। তার ঠিক করার জন্যে ইলেকট্রিশিয়ান আনার জন্যে খবর পাঠাতে হবে নেত্রকোনায়। আলসেমির জন্যে খবর পাঠানো হচ্ছে না। আনিস রোজ রাতে ভাবে কালই লোক পাঠাবে। সকালে মনে থাকে না। কাল অবশ্যই লোক পাঠাতে হবে। নবনী চিঠি লিখেছে সে আসবে। নবনী শীতের দিনেও এসি ছাড়া ঘুমুতে পারে না। ফ্যান তো লাগবেই। আশ্বিন মাসে দিনে রোদের তাপ বেশি। রাতটা অবশ্যি ঠাণ্ডা–তারপরেও ফ্যান লাগবে।
নবনীর এবারের চিঠিটা নিয়েও আনিস সামান্য চিন্তিত। চিঠির কথা কেমন যেন এলোমেলো! তার কি কোনো সমস্যা যাচ্ছে? সমস্যার ব্যাপারটা লেখা নেই। লেখা থাকলে ভালো হতো–আনিস চিন্তা করতে পারত। প্ৰায় রাতেই তার কোনো কাজ থাকে না। তখন কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে।
আনিস বালিশের নিচ থেকে নবনীর চিঠি বের করল। এই চিঠি এর মধ্যেই কয়েকবার পড়া হয়েছে। আরো একবার পড়লে ক্ষতি কিছু নেই।
ডাক্তার সাহেব,
কেমন আছ তুমি? জঙ্গলে দিনকাল কেমন কাটছে? অসহ্য বোধ হওয়া শুরু হয় নি? আমি যখন ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে বাবার সঙ্গে বেড়াতে যেতম প্রথম দিন খুব ভালো লাগত। দ্বিতীয় দিনে ভালো লাগাটা কমে যেত। তৃতীয় দিন থেকে অসহ্য লাগা শুরু হতো। তুমি কীভাবে বৎসর পার করে দিচ্ছে ভাবতে অবাক লাগছে।
আমি ভেবে দেখলাম-তুমি তেল আমি জল। তোমার পছন্দ এক রকম। আমার অন্য রকম। বিবাহ নামক ঝাকুনি যন্ত্রের মাধ্যমে তেল জল মিশে যাচ্ছে। আবার ঝাকুনি বন্ধ হলেই তেল আলাদা, জল আলাদা। আমাদের সার্বক্ষণিক সুখে থাকার জন্যে প্রবল ঝাঁকুনি যন্ত্র দরকার। সে রকম যন্ত্র আবিষ্কৃত হয় নি বলে আমি ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তায় আছি।
তোমার এখানে তিন দিনের জন্যে আসব। প্ৰথম দিন আমার খুবই ভালো লাগবে। দ্বিতীয় দিন ভালো লাগাটা একটু কমবে। তৃতীয় দিনে অসহ্য বােধ হতে থাকলে তখন চলে আসব। কিছু মানুষ আছে অসহনীয় অবস্থা সহনীয় করার জন্যে চেষ্টা চালায়। আমার এবং তোমার, আমাদের দু’জনেরই দুৰ্ভাগ্য আমি সে রকম না। আমি কেন এ রকম হয়েছি সেটা নিয়ে ভেবেছি। উত্তর পাই নি।
তোমাকে জানানো হয় নি ইদানিং আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়া-আসা করছি। ভদ্রলোক আমাদের আত্মীয় এবং আমাকে ছোটবেলা থেকেই খুব স্নেহ করেন। সাইকিয়াট্রিক্টের কাছে যাবার উদ্দেশ্য হলো–তিনি যেন রাতে ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন দেখার হাত থেকে আমাকে বঁচোন। একবারতো। আমি তোমাকে লিখেছিলাম যে আমি দুঃস্বপ্ন দেখি। সেই দুঃস্বপ্নগুলো কত ভয়ঙ্কর তা লেখা হয়। নি। রাতে দেখা ভয়ের স্বপ্নগুলো যখন দিনে মনে করি বা কাউকে বলতে যাই তখন খুবই হাস্যকর মনে হয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে কী স্বপ্নে দেখেছি শোন–দেখলাম আমি পুরনো ধরনের রেলিং দেয়া খাটে শুয়ে আছি। খাটের চারদিকে রেলিং ধরে আট ন’জন বোরকাপরা মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। এবং সবাই হাত বাড়িয়ে আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছেন। আমি নিশ্চিত যে তোমার কাছে স্বপ্নটা মোটেই ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে না। এখন আমার কাছেও মনে হচ্ছে না। কিন্তু স্বপ্নটা দেখার সময় কী যে ভয় পেয়েছিলাম! আমি সাইকিয়াট্রিস্ট চাচার পরামর্শ মতো একটা খাতা বানিয়েছি। সেই খাতার নাম দিয়েছি। স্বপ্ন-খাতা। আমি এই খাতায় স্বপ্নগুলো লিখে রাখছি। তোমার এখানে আসার সময় খাতাটা নিয়ে আসব। তুমি পড়ে দেখ। আমি নিশ্চিত তুমি মজা পাবে।
সাইকিয়াট্রিস্ট চাচা আমাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কী সিদ্ধান্তে এসেছেন শুনতে চাও? তার সিদ্ধান্ত হলো—আমি নাকি মানসিকভাবে বিয়েটা মেনে নিতে পারছি না। তোমার সঙ্গে বিয়ে আমার মনের ওপর প্রবল চাপ ফেলেছে। এই মানসিক চাপই স্বপ্ন হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এটা সাইকিয়াট্রিস্টেরর সিদ্ধান্ত। তোমার সিদ্ধান্ত কী? ভালো থেকো।
নবনী
আনিসের শরীর কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। জ্বর কি বেড়েছে? ঘরে থাৰ্মেমিটার নেই। ক্ষিধে লেগেছে, কিন্তু খেতে ইচ্ছা করছে না। দুটা বিপরীতমুখী ব্যাপার একসঙ্গে কী করে ঘটে? শরীর যন্ত্র নষ্ট হলে এরকম হয়। জলাতংকের রোগীর তৃষ্ণায় বুক ফাটে কিন্তু পানি খেতে পারে না। না উদাহরণটা ঠিক হলো না। জলাতংকের রোগীর তৃষ্ণা হয়, পানিও খেতে চায়–খিঁচুনির জন্যে খেতে পারে না।