স্কুল ঘরের সামনে কয়েকটা চেয়ার এবং দুটা বেঞ্চ রাখা হয়েছে। মাঝখানের চেয়ারে চেয়ারম্যান সাহেব পা তুলে বসেছেন। তার পরনে ধবধবে সাদা সিস্কের লুঙ্গি। গায়ে পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবিও ধবধবে সাদা। তবে সিস্কের না। বলে চকচক করছে না। চেয়ারম্যান সাহেবের মুখ ভর্তি পান। পান খেলেই তার মুখ হাসিহাসি হয়ে যায়। তার মুখ হাসিহাসি। চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে আছেন হাই স্কুলের হেডমাস্টার বাবু ঈশ্বরচন্দ্র এম.এ.বি.টি.। হেডমাস্টার সাহেবের সঙ্গে স্কুলের কয়েকজন শিক্ষকও আছেন। শিক্ষকরা সবাই চুপচাপ। তারা গত তিন মাসে কোনো সরকারি ডিএ পাচ্ছেন না। ছাত্র বেতনের আদায় খুবই সামান্য। জহির খাঁ সাহেব প্রতি মাসে স্কুলে বেশ কিছু টাকা দেন। গত দু’মাসে সেই টাকাও দিচ্ছেন না। ঘটনা কী জানা যাচ্ছে না। শিক্ষকরা শংকিত। বিরাটনগরের গণ্যমান্যদের মধ্যে সরকার বাড়ির ইরফান সরকার আছেন। নয়াবাড়ির আজিজ মিয়াও সেজোগুজে উপস্থিত হয়েছেন। আরো কিছু লোকজনের আসার কথা, তারা এখনো এসে উপস্থিত হন নি। আছরের নামাজের পর সবাইকে আসতে বলা হয়েছে। আছরের নামাজের সময় মাত্র হয়েছে। তবে বাজার থেকে বেশ কিছু লোকজন এসেছে। তারা আলাদা বসেছে। বাজারের লোকজনদের সম্মানের চোখে দেখা হয় না। গ্রামের সালিশি। বৈঠকে তারাও থাকে, তবে আলাদা থাকে।
চেয়ারম্যান সাহেব নয়াবাড়ির আজিজ মিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, পুকুর কাটাইতেছ শুনলাম।
আজিজ মিয়া বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, একটা ইচ্ছা আছে। ছেলে টাকা পাঠায়েছে–তার ইচ্ছা বড় একটা পুকুর। পাথরের ঘাটলা হইব। পুলাপাইন্যা।
চেয়ারম্যান সাহেব আরো একটা পান মুখে দিতে দিতে বলল, খারাপ কী?
আজিজ মিয়া উত্তেজিত গলায় বলল, ছেলে চিঠিতে লিখেছে—আব্বাজান পুকুরে মাছ ছাড়িবেন কিন্তু মাছ বিক্রয় করিবেন না। মাছ বড় হউক। দেশে ফিরিয়া হুইল বর্শি দিয়া মাছ ধরিব।
জহির খাঁ পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, চিঠি মুখস্থ করে বসে আছ। পুরা চিঠি মুখস্ত, না। এই দুই লাইন মুখস্ত?
আজিজ মিয়া লজ্জিত মুখে বলল, অনেকবার কইরা এক চিঠি পড়ি–ইয়াদ থাকে।
তোমার ছেলে ভালো দেখাইছে।
আপনাদের দেয়া।
জহির খাঁ সামান্য গম্ভীর হয়ে গেলেন। আজিজ মিয়া বছর সাতেক আগেও হত দরিদ্র ছিল। ফসল তোলার সময় অন্যের ক্ষেতে কমলা দিত। তার ছেলে কীভাবে কীভাবে কুয়েত চলে গেল। তারপর টাকা পাঠাতে শুরু করল। আজিজ মিয়ার বাড়িতে টিনের ঘর উঠল। সেই টিনের ঘরের পাশে উঠল পাকা বাড়ি। আজিজ মিয়া জমি কেনা শুরু করল। বাজারে ঘর নিল। এখন জানা গেল পুকুর কাটা হবে। জহির খাঁর কানে এসেছে যে আজিজ মিয়া বলে বেড়াচ্ছে–এমন পুসকুনি দিব যে চেয়ারম্যান সাহেবের পুসকুনিরে আমার পুসকুনির সামনে মনে হইব ব্যাঙের ছাতা। অতি অপমানসূচক কথা। জহির খাঁ বিশ্বাস করেন না আজিজ মিয়া এ ধরনের কথা বলতে পারে। তবে পুরোপুরি অবিশ্বাসও করা যায় না। ছোটলোকের যদি হঠাৎ পয়সা হয় তাহলে পয়সার গরমে পাছা গরম হয়ে মায়। মাথা গরম লোক অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলে–সেইসব কথার মাপ থাকে। পাছা গরম লোকের কথার কোনো মাপ থাকে না।
আজিজ মিয়া তৃপ্তির সঙ্গে বলল, ছেলেটা লোক মারফত আমারে আর তার মারে মক্কা শরিফ থাইক্যা কাফনের কাপড় কিন্যা পাঠাইছে। বড়ই আনন্দের ব্যাপার! এই কাপড় কাবা শরীফ ছুঁয়াইয়া আনাইছে।
ভালো তো।
আবার চিঠিতে লিখেছে। হজ্জ কইরা যাইতে। সে ব্যবস্থা করবে।
যাও, হজ্জ কইরা আস।
ইচ্ছা আছে কিন্তু নানান ঝামেলায় জড়াইয়া পড়ছি—বাজারে আরেকয়া নয়া ঘর নিছি।
বাজারে ঘর নিয়েছ?
জ্বি, দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে।
ভালো তো।
জহির খাঁ পানের পিক ফেললেন। তার কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ল–বিরাটনগরে অনেক কিছুই ঘটছে। যার খোঁজ তিনি রাখেন না। বাজারে ঘর রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে সেই খবরও তিনি পান নি এটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। আজিজ মিয়া তলে তলে সুড়ং কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। লোকটা অতি বুদ্ধিমান। ছোটলোকের হাতে হঠাৎ পয়সা এলে নানান আলামত দেখা যায়। এরা তখন বড় কার্প মাছ ছাড়া ভাত খেতে পারে না। আড়ং-এ ষাড়ের লড়াইয়ের জন্যে ষাঁড় কিনে ফেলে। সপ্তাহে দুই দিন যায় নেত্রকোনা ছবি দেখার জন্যে। আজিজ মিয়া তার কিছুই করছে না–জমি কিনছে, বাজারে ঘর রাখছে। তিনি খবর পেয়েছেন আজিজ মিয়া ব্যবসা ভালোই বুঝে। সরিষার ব্যবসা করে এই বৎসর অনেক টাকা কামিয়েছে।
স্কুলের দপ্তরি নাশতা নিয়ে এল। ধামাভর্তি মাখানো মুড়ি। পেঁপে। ঈশ্বর বাবু বিনীত গলায় বললেন, চেয়ারম্যান সাব নাশতা করেন। চা আসতেছে। গুড়ের রং চা করতে বলেছি। গুড়ের চা আপনার পছন্দ।
জহির খাঁ হাই তুলতে তুলতে বললেন, তোমরা খাও। আমার মুখে পান।
ঈশ্বর বাবু নিচু গলায় বললেন–ভালো নাশতার আয়োজন করার ইচ্ছা ছিল। স্কুল ফান্ডের অবস্থা শোচনীয়। ক্লাসটেনে ছাত্র মাত্র সাতজন।
জহির খাঁ গম্ভীর গলায় বললেন, ছাত্র কম কেন? পড়াশোনা ভালো হয় না?
ঈশ্বরচন্দ্ৰ হতাশ গলায় বললেন–যে সব স্কুলে সেন্টার পায় সেখানে ছাত্র হয়। নকলের সুবিধা হয় কি-না সেটা সবেই আগে দেখে। খুবই দুর্দশায় আছি। অঞ্চলের বিশিষ্ট গণ্যমান্যরা যদি না দেখে তাহলে স্কুল উঠায়ে দিতে হবে।
দাও উঠায়ে দাও। সবকিছুর জন্ম মৃত্যু আছে। স্কুলেরও আছে। আফসোস কইরা তো লাভ নাই। আগে রাজা বাদশা ছিল, তারা হাতি পুষত। স্কুল কলেজ এইগুলা হইল হাতি। এখন রাজা বাদশা নাই–হাতিও থাকব না। সোজা হিসাব।