দরজা খুললেন নবনীর শ্বশুর সালেহ সাহেব। নবনীর মনে হলো তিনি খুবই চিন্তিত, বিরক্ত এবং উদ্বিগ্ন। মানুষটা ছোটখাট, দুশ্চিন্তায় এবং উদ্বেগে আরো ছোট হয়ে গেছেন। এই ভদ্রলোককে নবনীর কাছে কাটুন চ্যানেলে দেখায় এমন কোনো কাটুন ক্যারেক্টরের মতো মনে হয়। কোন ক্যারেক্টার এটা মনে পড়ছে।
সালেহ সাহেব নবনীকে দেখে গলা নামিয়ে বললেন, বৌমা তুমি স্ট্রেইট আমার ঘরে চলে যাও। তোমার শাশুড়ির সঙ্গে কোনো কথা বলবে না। আগে আমার কথা শুনবে–তারপর তুমি যদি তার কথা শুনতে চাও শুনবে। তুমি এসে ভালো করেছ। আমি তোমাকে টেলিফোন করে আনাবার ব্যবস্থা করছিলাম। নাম্বারা ভুলে গেছি বলে টেলিফোন করতে পারছিলাম না। নাম্বার তোমার শাশুড়ির কাছে। তার কাছে।তো আর নাম্বার চাইতে পারি না।
নবনী চিন্তিত গলায় বলল, নাম্বার চাইতে পারেন না কেন?
অবস্থা সে রকম না। আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ। তুমি নতুন বউ। তোমার চোখে যেন কিছু না পড়ে এই জন্যে ঢাকা দিয়ে রাখি। ঢাকাঢাকি আর সম্ভব না। এনাফ ইজ এনাফ।
নবনী বলল, আপনাদের জন্যে একটা মাছ এনেছিলাম। গাড়িতে আছে।
রাখি তোমার মাছ। আসা, আমার ঘরে আস।
সালেহ সাহেব উত্তেজনায় কাপছেন। কথাও ঠিকমতো বলতে পারছেন না–শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ লাল–মনে হচ্ছে গত রাতে ঘুমান নি।
সালেহ সাহেব নবনীর হাতে ধরে প্রায় টানতে টানতে তাঁর নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। ছোট্ট ঘর। লেখার টেবিল আর বুক শেলফ ভর্তি ম্যাগাজিন ছাড়া আর কিছু নেই। রিটায়ার করার পর থেকে প্রতি দুপুরে এই ঘরের মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে তিনি ঘুমান। স্ত্রীর সঙ্গে মন কষাকষি হলে রাতেও তাকে এই ঘরে থাকতে হয়।
ঘরে একটা মাত্র চেয়ার। সেই চেয়ারে নবনীকে তিনি বসালেন। হাত নাড়তে নাড়তে হড়বড় করে কথা বলতে লাগলেন।
মা, খুব মন দিয়ে ঘটনাটা শোন। ঘটনার সূত্রপাত দুই দিন আগে। হঠাৎ আমি লক্ষ করলাম–তোমার শাশুড়ি তার মুখের ওপর সব সময় একটা বই ঘরে আছে–বইটার নাম হলো ‘সাত কাহান’। সমরেশ মজুমদারের লেখা। মা তুমি বইটা পড়েছ?
জ্বি না।
আমিও পড়ি নাই। তোমার শাশুড়ি যা করে তার মধ্যে বাড়াবাড়ি থাকে। এই যে পড়ছে। এর মধ্যেও বাড়াবাড়ি আছে। সবসময় মুখের সামনে বই ধরে রাখা চাই। রাতে ঘুমাতে যাচ্ছি। সে বাতি জ্বালিয়ে বই পড়ছে। বাতি জ্বালানো থাকলে আমার ঘুম হয় না। এটা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। বই নিয়ে ঢং করতে পারলেই হলো। সকালে নাশতা খাচ্ছি। সেখানেও মুখের সামনে বই।
তারপর?
আমি আজ নাস্তার টেবিলে খুবই ভদ্র ভাষায় বললাম, বই যে পড়ছ–কাহন শব্দের অর্থ জান?
সে বই থেকে চোখ না তুলে বলল, না।
আমি সামান্য রাগ করে বললাম, একটা বই পড়ছি, তার নামের অর্থ জানার ইচ্ছা হলো না?
সে বই থেকে চোখ না তুলে বলল, পড়ার সময় বিরক্ত করবে না।
আমি বললাম, ঘরে চারটা ডিকশনারি। একটা ডিকশনারি দেখলেওতো অর্থটা জানতে পারতে। সে বই নিয়ে গাঁটগাট করে শোবার ঘরে চলে গেল।
নবনী বলল, আপনিও উনার পেছনে পেছনে শোবার ঘরে গেলেন?
অবশ্যই। তাকে গিয়ে খুবই ভদ্রভাবে বললাম, নামের অর্থ জানলে বইটা পড়ে আরাম পাবে। তুমি একটা ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিচ্ছ, সেই ছেলের নাম জানবে না। এটা কেমন কথা!
তোমার শাশুড়ি থমথমে গলায় বলল, বই পড়া আর মেয়ে বিয়ে দেয়া এক হলো?
আমি বললাম, অবশ্যই এক।
তখন সে খটাস করে বই বন্ধ করে রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল–বল কাহনের অর্থ কী আমাকে বল। অর্থ জেনে তারপর পড়ব।
আমি তোমার শাশুড়ির ভাবভঙ্গি দেখে একটু টেনশনে পড়ে গেলাম। তার নেচারতো জানি। লোকজন তিলকে তাল করে। তোমার শাশুড়ি তিলকে বড় সাইজের কঁঠাল করে। ভালো কথা মা, তুমি কি কাহন শব্দের অর্থটা জান?
জ্বি না। কাহনের অর্থ কি কাহিনী? সাত কাহন হলো সাত কাহিনী।
না। কাহিনী হলো সংখ্যাবাচক। ঐ যে—
চার কড়ায় এক গণ্ডা
দুই গণ্ডায় এক পন
ষোল পনে এক কাহন।
কাজেই এক কাহন হলো একশ বত্ৰিশ। এক কাহন আম মানে একশ বত্ৰিশটা আম। সাত কাহন মানে হলো নয়শ চব্বিশ।
নবনী হাসি মুখে বলল, বই এর নাম নয়শ চব্বিশ?
হ্যাঁ তাই। এটা তোমার শাশুড়িকে বললাম। বলার পর সে যে কী করল। তুমি বিশ্বাস করবে না। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মহিলা এই কাজটা করতে পারে না। সে বলল, কাহন নামের অর্থ জানার পর বইটা পড়তে ভালো লাগছে না। এই বলে জানোলা দিয়ে বইটা ফেলে দিল। বই পড়ল নর্দমায়। ঘটনার এই হলো সারমর্ম। মা আমি ঠিক করেছি, তোমার শাশুড়ির সঙ্গে এক ছাদের নিচে আমি আর বাস করব না। স্বামী-স্ত্রীর একজন যদি উত্তর মেরু হয় এবং আরেকজন যদি হয় দক্ষিণ মেরু তাহলেও এক ছাদের নিচে থাকা যায়। কিন্তু আমাদের অবস্থাটা দেখ–আমি হলাম দক্ষিণ মেরু; তোমার শাশুড়ি উত্তর মেরু ও না, এক্কেবারে মঙ্গল গ্ৰহ। আমাদের এক ঘরে থাকা সম্ভবই না।
আপনি যাবেন কোথায়?
তোমার কি ধারণা আমার থাকার জায়গার অভাব? থাকার জায়গার আমার অভাব নাই। সুটকেস, বিছানা গুছিয়ে রেখেছি। তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে–ভালোই হয়েছে। তুমি আনিসকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিও। প্রয়োজন বোধে টেলিগ্রামও করতে পার।
নবনী আতঙ্কিত গলায় বলল, আপনি সত্যিই সত্যিই চলে যাবেন না-কি?
সালেহ সাহেব থমথমে গলায় বললেন, অবশ্যই চলে যাব। তুমি মা আমাকে চিন নাই। আমি দুই কথার মানুষও না, তিনি কথার মানুষও না। আমি এক কথার মানুষ। আমি ঐ Old vixen এর সঙ্গে বাস করব না। wixem মানে জানতো মা? vixenমানে হলো মহিলা শিয়াল। আমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি চলে যাব, তখন অবশ্যই চলে যাব।