এখনো বলে নি। নতুন বউতো, চক্ষুলজ্জায় কিছু বলতে পারছে না। লজ্জাটা কেটে গেলে বলবে।
এরা বোধহয় তোর ব্যাপার স্যাপার টের পায় নি। তুইতো থাকিস এখানে। শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে তোর বোধহয় দেখাই হয় না?
সপ্তাহে একদিন যাই।
আজ যাবি?
না।
এক কাজ কর—আজ যা।
আজ যেতে বলছ কেন?
ওদের একটা সারপ্রাইজ দে। আমি বিরাট এক মাছ কিনে এনে দেব। মাছ নিয়ে যা। তোর শ্বশুর শাশুড়ি খুশি হবে। আমি নিউমার্কেট লোক পাঠাচ্ছি। বাজারের সবচে’ বড় মাছটা কিনে আনবে। বাংলাদেশে এমন কোনো মানুষ নেই যে বড় মাছ দেখে খুশি হয় না।
তাদের খুশি করার আমার দরকার কী?
মানুষকে খুশি করার মধ্যে আনন্দ আছে। সেই মানুষ যদি শ্বশুর শাশুড়ি হয় তাহলেতো কথাই নেই। মাছ কিনতে পাঠাব?
না!
সেকেন্ড থট দিবি?
সেকেন্ড শুধু না আমি ফোর্থ থট পর্যন্ত দিয়ে ফেলেছি। মাছ নিয়ে আমি শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি। এটা ভাবতেই ঘেন্না লাগছে। চারদিকে মাছ মাছ গন্ধ পাচ্ছি। এই যে চা খাচ্ছি চায়ের মধ্যেও মাছের আঁশটে গন্ধ।
নবনীর চা শেষ হয়ে গেছে। কথা বলতে বলতে চা খাওয়া হয়ে গেছে বলে চা খাওয়ার মজাটা ঠিক পাওয়া যায় নি। আরেক কাপ খেতে পারলে ভালো হতো। তার জন্যে যন্ত্রণা করতে হবে। দোতলা থেকে একতলায় নামতে হবে। তাদের বাড়ির রান্নাঘর, খাবার ঘর, বসার ঘর, লাইব্রেরি সবই এক তলায়। দুতলাটা স্লীপিং কোয়ার্টার। দুটা প্ৰকাণ্ড শোবার ঘর। একটা তার, অন্যটা তার বাবার। মাঝখানে ছোটখাট খেলার মাঠের মতো ফ্যামিলি লাউঞ্জ আছে। সেখানে টিভি, মিউজিক সেন্টার। ফ্যামিলি লাউঞ্জে মোটা গদির ডিভান আছে। শুয়ে শুয়ে ছবি দেখা হলো নবনীর ছোটবেলাকার অভ্যাস। মানুষের কিছু ছোটবেলাকার অভ্যাস বাড়বেলাতেও থেকে যায়। নবনীর এই অভ্যাসটি রয়ে গেছে।
দ্বিতীয় কাপ চায়ের জন্যে নবনীকে এক তলায় রান্নাঘরে যেতে হবে। যতক্ষণ ফরহাদ সাহেব আছেন ততক্ষণ কাজের লোকদের কেউই দোতলায় আসবে না। তাদের সে রকম নির্দেশ দেয়া আছে। নবনীর এক তলায় নামতে ইচ্ছা করছে না। ফরহাদ সাহেব বললেন, মুখ শুকনা করে বসে আছিস কেন?
নবনী জবাব দিল না। ফরহাদ সাহেব পত্রিকা ভাঁজ করতে করতে বললেন–আজ ইউনিভার্সিটি নেই?
দুটার সময় একটা ক্লাস আছে।
যাবি না?
এখনো বুঝতে পারছি না।
কখন বুঝতে পারবি?
ক্লাস শুরু হবার আধঘণ্টা আগে বুঝতে পারব।
ফরহাদ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেললেন।
নবনী বলল, হাসছ কেন?
তোর অভিনয় দেখে হাসছি?
নবনী বিস্মিত হয়ে বলল, অভিনয় কী করলাম?
ইনডিসিশনের একটা সুন্দর অভিনয় তুই সব সময় করিস। প্রায়ই দেখি তোর মধ্যে একটা দিশাহারা ভাব–কাজটা করব কি করব না। আমি একশ ভাগ নিশ্চিত ভাবটা লোক দেখানো। কেন এরকম করিস?
নবনী জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ফরহাদ সাহেব বললেন, কোথায় যাচ্ছিস?
চা আনতে যাচ্ছি। তুমি দোতলায় আছ–এখন হাজার ডাকাডাকি করেও কাউকে আনা যাবে না। বাবা, তোমাকে কি এক কাপ চা দিতে বলব? খাবে?
না। তোর দুঃস্বপ্ন দেখা কেমন এগুচ্ছে?
ভালোই এগুচ্ছে।
কাল রাতেও দেখেছিস?
হুঁ।
খাতায় সব লিখছিস?
হুঁ লিখছি।
সাইকিয়াট্রিস্ট কে খাতাটা দেখতে দিয়েছিস?
না।
দিসতো আমাকে খাতাটা। পড়ে দেখব ঘটনা। কী।
আচ্ছা। ফরহাদ সাহেব হঠাৎ সামান্য গম্ভীর হয়ে গেলেন। তবে মুখের হাসি আগের মতোই রইল। চোখ। গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করি।–সরাসরি জবাব দিবি। নকল কনফিউশান না। স্ট্রেইট আনসার–ইয়েস নো টাইপ। প্রশ্নটা হলো–আনিস ছেলেটাকে কি তোর পছন্দ হয়েছে?
নবনী সঙ্গে সঙ্গে বলল, না।
পছন্দ হয় নি কেন?
কারণগুলো নিয়ে চিন্তা করি নি। পছন্দ হয় নি এইটুক জানি।
সে কি তোকে পছন্দ করেছে?
হ্যাঁ করেছে। আমার যত সমস্যাই থাকুক আমি পছন্দ করার মতো মেয়ে।
আনিসের সঙ্গে তোর কি এখন যোগাযোগ নেই?
আছে। সে সপ্তাহে দু’টো করে চিঠি পাঠায়।
তুই চিঠি লিখিস না?
আমিও লিখি।
তুই কটা চিঠি লিখিস?
আমিও সপ্তাহে দু’টো। আর কিছু জিজ্ঞেস করবে?
না।
আমি কি এখন চায়ের সন্ধানে এক তলায় যেতে পারি?
ফরহাদ সাহেব জবাব দিলেন না। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাকে খুবই চিন্তিত মনে হলো। আজ তিনি অফিসে যান নি মেয়েকে এই কথাগুলো জিজ্ঞেস করার জন্যে। কথা জিজ্ঞেস করা হয়েছে–এখন তিনি যেতে পারেন। দুপুর একটায় জাপানি ডিজাইনার মি. ওসাকু সানের সঙ্গে তাঁর লাঞ্চের ব্যবস্থা আছে। ওসাকু সান চিনামাটির বাসনকোসনের ডিজাইন দেখাবেন। এই জাপানি শিল্পী না-কি বাংলাদেশী মাটিফ নিয়ে কাজ করেছেন। ফরহাদ সাহেবের দুপুরের লাঞ্চে যেতে ইচ্ছা করছে না। তিনি নিজের ওপর সামান্য বিরক্ত বোধ করছেন। তাঁর মেয়ের বয়স বাইশ। সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে পারে। তাঁর বয়স সাতান্ন। তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে পারেন না।
নবনী নিজেই চা বানোল। নিজের হাতে বানানো চা তার নিজের কখনো পছন্দ হয় না। আজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মন ভালো হয়ে গেল। চমৎকার চা হয়েছে। লিকার ঘন হয় নি। আবার পাতলাও হয় নি। চিনি যতটুকু দেয়া হয়েছে তারচে’ এক দানা বেশি হলে চা মিষ্টি হয়ে যেত। একদানা কম হলেও মিষ্টি কম লাগত। চা হলো এমন এক পানীয় যার সব অনুপাত নির্দিষ্ট এবং একেক জনের জন্যে একেক রকম।
নবনীর মন এখন ভালো। মন ভালো থাকা অবস্থায় ছোটখাট কিছু অপ্রিয় কাজ করে ফেলা যায়। তেমন খারাপ লাগে না। নবনী ঠিক করে ফেলল কলাবাগানে তার শ্বশুরবাড়িতে যাবে। মাছ সঙ্গে নিয়েই যাবে। দুপুরে ঐ বাড়িতেই খাবে। বাবাকে বলে মাছ কিনাতে হবে। কাউকে ফার্মেসিতে পাঠিয়ে এক পাতা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট আনাতে হবে। শ্বশুর সাহেবের সঙ্গে কথা বলার সময় অবশ্যই তার মাথা ধরবে। হাতের কাছে মাথা ধরার ট্যাবলেট থাকা দরকার। আজ একটা ছোটখাট এক্সপেরিমেন্টও করা যেতে পারে–মাথা ধরার ট্যাবলেট আগেভাগে খেয়ে রাখা। মাথা ধরার সুযোগই হবে না। শরীরে আগে থেকেই ওষুধ বসে আছে।