কাজ বন্ধু স্যার।
বন্ধ কেন?
পার্টস নাই।
পার্টস নাই, তাহলে শুধু শুধু বসে আছেন কেন?
স্যার চলে যাব?
অবশ্যই চলে যাবেন। এক থেকে পাঁচ গুনার আগেই যাবেন। ওয়ান টু থ্রি ফোর…
মেশিনটা জায়গায় ফিট কইরা থুইয়া যাই?
নো। এক্ষুণি বিদায় হতে হবে। রাইট নড়ি।
জাফর সাহেব বুঝতে পারছেন তাঁর রাগ বিপদসীমা অতিক্রম করতে যাচ্ছে। এক্ষুণি ভয়াবহ কিছু হবে। এদের উপর রাগ করাটা অর্থহীন। স্ত্রীর উপর রাগ তিনি এদের উপর ঝাড়তে পারেন না…
এমন এক বিপজ্জনক মুহূর্তে নুরুজ্জামান দরজা ঠেলে মাথা বের করে বলল, স্যার আসি?
জাফর সাহেব থমথমে গলায় বললেন, কি ব্যাপার!
কোন ব্যাপার না স্যার। আপনার অফিসের ঠিকানা ছিল। ভাবলাম দেখা করে যাই। মৌচাক মার্কেটে যাচ্ছিলাম।
আমার সঙ্গে কি কোন দরকার আছে?
জ্বি-না স্যার।
তাহলে এলে কেন?
নুরুজ্জামান ভয়ে ভয়ে বলল, মন্ত্রী সাহেবের পিএ-র সঙ্গে কথা হয়েছে। উনি আবার নেত্রকোনায় বিবাহ করেছেন।
উনি নেত্রকোনা বিয়ে করেছেন তাতে কি হয়েছে?
যোগাযোগের একটা সুবিধা হয়ে গেল।
জাফর সাহেব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এতটা নির্বোধ কোন সুস্থ মানুষ হতে পারে তা তার ধারণায় নেই। চতুস্পদরা এরচে কিছু বেশি বুদ্ধি ধরে।
নুরুজ্জামান বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সামনের চেয়ারে বসেছে। জাফর সাহেব যে রেগে আগুন হয়ে আছেন তাও তার মাথায় ঢুকছে না। নুরুজ্জামান উৎসাহের সঙ্গে বলল, পি এ সাহেবের বাসায় একদিন চলে যাব। একটা ব্যবস্থা তখন হবেই।
হুট করে একজন অপরিচিত মানুষের বাসায় উঠে যাবে?
হুট করে যাব না। আগে টেলিফোন করব। টেলিফোন নাম্বার নিয়ে এসেছি।
জাফর সাহেব লক্ষ্য করলেন নুরুজ্জামান টেলিফোন সেটটার দিকে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখান থেকে টেলিফোন করবে এই মতলব করেই এসেছে। এই যদি মতলব হয় তাহলে তাকে খুব নির্বোধ বলা যাবে না। জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক W151
স্যার একটা টেলিফোন করব?
কাকে করবে পি এ সাহেবের স্ত্রীকে?
জ্বী না। আমাদের দেশের একজন মানুষ আছে রামপুরায় বাসা। উনি আমাকে একটা সুযোগ করে দিবেন বলেছিলেন।
কিসের সুযো?
বাঁশি বাজাবার সুযোগ। টিভিতে বাঁশি বাজাব।
তুমি বাঁশি বাজাতে জান?
পাতার বাঁশি স্যার। দুটা পাতা ভাঁজ করে ঠোঁটের ভেতর দিয়ে …
নুরুজ্জামান।
জ্বী স্যার।
আমি এখন অত্যন্ত জরুরি একটা কাজ করছি। আমার মন মেজাজও ভাল নেই–তুমি যাও।
জ্বী আচ্ছা স্যার।
জাফর সাহেব লক্ষ্য করলেন, নুরুজ্জামান তাঁর কথায় দুঃখিতও হল না। আপমানিত বোধ করল না। হাসি মুখে উঠে দাড়াল। সহজ গলায় বলল, স্যার বাসায় ফিরবেন কখন?
কেন?
বাসায় ফেরার সময়টা জানা থাকলে এখানে চলে আসতাম তারপর আপনার সাথে একসঙ্গে গাড়িতে চলে যেতাম। গাড়িতে চড়ার মজাই অন্যরকম।
আমি পাঁচটার সময় বাসায় যাব।
জ্বী আচ্ছা স্যার। আমি চলে আসব।
জাফর সাহেবের মাথা দপদপ করছে। জ্বর এসে গেছে কিনা কে জানে। বমি বমি ভাব হচ্ছে। অতিরিক্ত মেজাজ খারাপ হলে তার এমন বমি বমি ভাব হয়।
নুরুজ্জামান বলল, স্যার যাই। স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
জাফর সাহেব ফাইল সামনে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। মেজাজ এতই খারাপ যে ফাইলের দিকেও তাকাতে পারছেন না। অথচ পুরো ফাইল আজ দিনের মধ্যেই দেখে দিতে হবে।
ঝাঁ ঝাঁ রোদে নুরুজ্জামান হাঁটছে। এমন ভাবে হাঁটছে যেন এই শহরটা তার খুবই পরিচিত। তার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। দুপুরে এখনো কিছু খাওয়া হয় নি। এক হোটেলে খেতে বসেছিল। দাম শুনে বুক ধড়ফড় শুরু হল। এক পিস মাছ কুড়ি টাকা। ভাত ফুল প্লেট পাঁচ টাকা পরের হাফ দু ঢাকা ডাল এক বাটি পঁাচ টাকা। একবেলা খেতেই বত্রিশ টাকা। অসম্ভব ব্যাপার। কাজেই এক কাপ চা খেয়ে সে। বের হয়ে এসেছে। চায়ের দামও নিল দু টাকা। টাকাটা একেবারে পানিতে পড়ে গেছে। এতটুক কাপে এক কাপ চা এর দাম দু টকি, পাগলের দেশ নাকি? টেলিফোন করতে গিয়েও পাঁচ টাকা নষ্ট হল। ফার্মেসী থেকে টেলিফোন করেছিল। এরা কল প্রতি তিনটাকা নেয়। পাঁচ টাকার একটা নোট দিল। তার নোটটা রেখে দিয়ে বলল, ভাংতি নাই। আরেক সময় এসে আরেকটা টেলিফোন করে যাবেন। এখন যান। বিরক্ত করবেন না।
নুরুজ্জামান একবার ভাবল বলে, টাকাটা দিন আমি ভাংতি করে দেই। শেষ। পর্যন্ত বলল না। এই লোকের মুখ দেখে মনে হচ্ছে বললেও লাভ হবে না।
নুরুজ্জামান এখন যাচ্ছে মৌচাকের দিকে।
ভরদুপুরে কারোর বাসায় উপস্থিত হওয়া ঠিক না, কিন্তু খবর পাওয়া গেছে। কামরুদ্দিন সাহেব বাসায় খেতে যান। তাকে ধরার এইটাই উৎকৃষ্ট সময়।
নুরুজ্জামান দুটা আনারস কিনল। এই সময় আনারস পাবার কথা না। ঢাকা শহরের ব্যাপারট্যাপার সবই অদ্ভুত। আনারস পাওয়া যাচ্ছে।
বাচ্চাকাচ্চার বাসা, খালি হাতে যাওয়া ঠিক না।
কামরুদ্দিন সাহেব বাসাতেই ছিলেন। দুপুরের খাওয়া শেষ করে পান মুখে দিয়েছেন। তার দুপুরে কিছুক্ষণ ঘুমানোর অভ্যাস–এই সময়ে দরজা খুলতে হল। নুরুজ্জামান হাসিমুখে বলল, স্যার চিনতে পারছেন? আমি নুরুজ্জামান।
কামরুদ্দিন বললেন, কি ব্যাপার?
বলেছিলেন ঢাকায় এলে যেন দেখা করি।
এখন তো একটু ব্যস্ত আছি।
তাহলে স্যার পরে আসি?
আচ্ছা আসুন, পরে আসুন।
আমাকে চিনতে পারছেন তো স্যার?–পাতার বাঁশি। বলেছিলেন একটা ব্যবস্থা করে দিবেন।
হুঁ।