এক্ষণে অন্য একটি বিষয়ের অবতারণা করিতেছি। নুরুজ্জামান ছেলেটিকে ভাল করিয়া লক্ষ্য কর। আমার অত্যন্ত পছন্দের ছেলে। তাহার কাজকর্ম নির্বোধের ন্যায়। তবে সে নির্বোধ নয়। তাহার মন কম্পাসের কাটার ন্যায় স্থির। এই সমাজে যাহা সচরাচর দেখা যায় না। তুমি গত চিঠিতে জানিতে চাহিয়াছিলে কোন ধরনের ছেলে তোমার বিবাহ করা উচিত। নুরুজ্জামান হচ্ছে সেই ধরনের ছেলে। আমার ধারণা, নুরুজ্জামানের মত কোন একজনের সঙ্গে তোমার বিবাহের ফল অত্যন্ত শুভ হইবে। আমি সরাসরি নুরুজ্জামানের কথাও বলিতে পারিতাম, বলিলাম না কারণ তোমাদের বাস্তবতা আমি জানি। আমার পত্রপাঠে রাগ করিও না বা বিরক্তও হইও না।
আমি যাহা ভাল বিবেচনা করিয়াছি তাহাই বলিয়াছি।…
বাকি চিঠি আর পড়তে ইচ্ছে করছে না। তিথি চিঠিটা দলা পাকিয়ে কাবার্ডের দিকে ছুঁড়ে মারল। দাদাজানের বুদ্ধিশুদ্ধি কি পুরোপুরিই গেছে?
জাফর সাহেবের ঘরে এয়ারকুলার
জাফর সাহেবের ঘরে এয়ারকুলার সারাবার মিস্ত্রী এসেছে। গোটা ভাদ্রমাস এয়ারকুলার বন্ধ ছিল। দেন-দরবার করেও মিস্ত্রী পাওয়া যায় নি। এখন শীত পড়ে গেছে। বিকেলে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে রীতিমত ঠাণ্ডা লাগে, আর এখন কি না এসেছে এয়ারকুলার ঠিক করতে। তাঁর ইচ্ছা করছে মিস্ত্রী দুজনকেই ঘাড় ধরে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে রাখতে। বাথরুমের শাওয়ারটা খুলে দিতে পারলে ভাল হত। সারাক্ষণ শাওয়ারের পানিতে ভিজুক। সব ইচ্ছা পূর্ণ হবার নয়। অপরিচিত কারোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা তাঁর ধাতে নেই। খারাপ ব্যবহার শুধু মাত্র প্রিয় এবং পরিচিতজনদের সঙ্গেই করা যায়। তিনি মিস্ত্রী দুজনের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, চা খাবেন?
দুজন একসঙ্গে বলল, খামু স্যার।
এদের আসার পর থেকেই জাফর সাহেব দেখছেন, এদের মতের মিল হচ্ছে না। একজন এক রকম করতে বলছে তো অন্যজন আরেক রকম বলছে। চা খাবার প্রশ্নে দুজনকেই তাৎক্ষণিকভাবে একমত হতে দেখা গেল। জাফর সাহেব চায়ের কথা বললেন। তিনি কাজে মন বসাতে পারছেন না। প্রায় দুশ পৃষ্ঠার এক গাবদা, ফাইল তার সামনে পড়ে আছে। আজ দিনের মধ্যে ফাইল পড়ে নোট দিতে হবে। পড়ায় মন বসছে না। মিস্ত্রী দুজন বিরক্ত করছে। অন্য কোথাও বসে যে কাজ করবেন সেই উপায় নেই। তিনি নিজের ঘর ছাড়া বসতে পারেন না। দম আটকে মাসে।
জাফর সাহেব ভুরু কুঁচকে বললেন, আপনাদের কাজ শেষ করতে কতক্ষণ লাগাবে।
ধরেন খুব বেশি হইলে আধা ঘণ্টা।
জাফর সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, আধঘণ্টা অপেক্ষা করা যেতে পারে। এই ফাঁকে শায়লার সঙ্গে কি কথা বলে নেবেন? বিনীত ভঙ্গিতে বলবেন, সব অপরাধ আমার। বাসায় ফিরে আস। দুটি মাত্র বাক, বলা কঠিন হবার কথা না। সব অপরাধ আমার–এই বাক্যটা বলাটাই সমস্যা। তিনি জানেন, সব অপরাধ তাঁর না। এটা বলা মানে মিথ্যা কথা বলা।
মিথ্যা বলা মানে আত্মার ক্ষয়। জন্মের সময় মানুষ বিশাল এক আত্ম নিয়ে পৃথিবীতে আসে। মিথ্যা বলতে যখন শুরু করে তখন আত্মা ক্ষয় হতে থাকে। বৃদ্ধ বয়সে দেখা যায়, আত্মার পুরোটাই ক্ষয় হয়ে গেছে। জাফর সাহেব সতেরো বছর বয়সের পর থেকে আত্মর ক্ষয়রোধ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। মানুষের সব চেষ্টা সফল হয় না। এটিও হচ্ছে না। পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। শায়লার সঙ্গে প্রায়ই মিথ্যা বলতে হচ্ছে। এই যে তিনি বলবেন, সব অপরাধ আমার এতে আত্মার অনেকটা ক্ষয় হবে।
জাফর সাহেব টেলিফোনের ডায়াল ঘুরালেন। তার মেজো মেয়ে ইরা ধরল। হাসি-খুশি গলা। বাড়ি ছেড়ে এই যে এতদিন বাইরে আছে তার কোন রকম ছাপ মেয়ের গলায় নেই।
হ্যালো বাবা, কেমন আছি?
ভাল।
তুমি কি অফিস থেকে টেলিফোন করছ?
হুঁ।
বাবা শোন, আমরা সিলেট বেড়াতে যাচ্ছি। ছোট মামার চা বাগানে।
কবে যাবি?
আজ রাতের ট্রেনে, সুরমা মেইল। মামা বলছিল গাড়িতে করে যেতে। বাই রোড। মা রাজি হল না।
ও আচ্ছা।
বাবা শোন, তুমি আমাদের সামনের মাসের হাত খরচের টাকাটা এডভান্স দিতে পারবে? একদম খালি হাতে সিলেট যাচ্ছি তো। ভাল লাগছে না।
কদিন থাকবি?
কদিন থাকব বলতে পারছি না। মা যতদিন থাকতে চায় ততদিন। বাবা, তুমি হাত-খরচের টাকা দেবে কি দেবে না তা তো বললে না?
পাঠিয়ে দেব।
থ্যাংকস।
তোর মা কি আছে?
আছে। কথা বলবে?
হুঁ।
ধর তুমি, ডেকে দিচ্ছি। তবে মা তোমার সঙ্গে কথা বলবে কি না তা তো জানি। মনে হয় বলবে না। যা রেগে আছে!
তুই ডেকে দে।
আচ্ছা।
জাফর সাহেব টেলিফোন হাতে বসে আছেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, মিস্ত্রী দুজন কাজ ফেলে হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। টেলিফোনের কথা শুনছে। এই দুটার মাথা কামিয়ে দিলে কেমন হয়? শায়লার গম্ভীর গলা পাওয়া গেল —
হ্যালো।
জাফর সাহেব বললেন, কেমন আছ?
আমি কেমন আছি সেটা দিয়ে তোমার দরকার নেই। কি বলতে চাচ্ছ বল।
সিলেট না-কি যাচ্ছ?
কেন–কোন অসুবিধা আছে? স্বামীর অনুমতি ছাড়া নড়তে পারব না।
অনুমতির কথা তো আসছে না। যেতে চাচ্ছ যাবে।
শায়লা গম্ভীর গলায় বললেন, রাখি?
শোন শায়লা, হ্যালো–আমি অনেক ভেবে-টেবে দেখলাম, অপরাধটা আসলে আমার। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, সংসারে চলার পথে ….?
খট করে শব্দ হল। শায়লা টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। জাফর সাহেবের দিকে মিস্ত্রী দুজন এখনো তাকিয়ে আছে। তিনি এমন ভাব করলেন যেন টেলিফোনে খুব আনন্দজনক সংবাদ পেয়েছেন। তিনি হাসিমুখে বললেন, আপনার কাজ কতদূর?