তিথি সহজ গলায় বলল, তোমাদের কি নেত্রকোনায় কোন দরজির দোকান আছে।
মারুফ হাসতে হাসতে বলল, আছে। এটা বাবার আরেক পাগলামি। আমাদের নবিজীর চার খলিফাদের একজন না-কি দরজির কাজ করতেন। তাই বাবাও ঠিক করলেন শেষ বয়সে ঐ লাইনে যাবেন। হা হা হা।
শোন মারুফ, তোমার বাবা অংকের প্রফেসর না দরজি, তাতে কিছু যায় আসে। আমি তোমার বাবাকে দেখে তোমাকে পছন্দ করিনি। তোমাকে দেখেই করেছি। তুমি যে ক্রমাগত মিথ্যা বলছ এতে ভয়ংকর কষ্ট পেয়েছি।
শোন তিথি। মিথ্যা যে আমি বলি না, তা না। মিথ্যা বলি। তবে কখনো তোমার সঙ্গে বলি না।
এখনো বলছ না?
না।
তিথি নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত স্বরে বলল, আগামীকাল আমাদের বিয়ে, কিন্তু আমি মনের দিক থেকে কোন সায় পাচ্ছি না। আমি বাবাকে বলে দিয়েছি, এই মুহুর্তে বিয়ের আমার কোন ইচ্ছা নেই। তোমার কাছেও খবর পাঠাতাম–ভাগ্য ভাল, তুমি টেলিফোন করলে। তোমাকেও জানিয়ে দিলাম।
তিথি শোন।
আমি এখন কিছু শুনতে চাচ্ছি না। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। রাখি কেমন?
বিয়ে তাহলে সত্যি সত্যি বাতিল?
হ্যাঁ।
আমার বাবা একজন দরজি–এই কারণে?
না এটা কোন কারণ না। আমার দাদাজান চাষাবাদ করেন, তার জন্যে তিনি মানুষ হিসেবে ছোট হয়ে যান নি।
আমাকে বিয়ে করা ছাড়া তোমার গতি নেই তিথি। তুমি অন্য কোথাও বিয়ে করতে পারবে না। আমি চিঠি লিখে সব জানিয়ে দেব।
কি জানাবে?
জানাব যে, তুমি আমার সঙ্গে রাত্রি যাপন করেছ। ওরা যাতে বিশ্বাস করে তার জন্যে তোমার ডান বুকে লাল তিলটির কথাও বলব।
আমার বুকে কোন লাল তিল নেই। আর থাকলেও তুমি দেখনি। সে সুযোগ আমি তোমাকে দেই নি।
মারুফ বলল, মিথ্যা যখন একবার বলা ধরেছি ভালভাবেই বলব। সবাই মিথ্যাটাই বিশ্বাস করবে। তুমি তো আর কাপড় খুলে সত্যি প্রমাণ করতে পারবে না। পৃথিবীর সবাইকে আমি বলব। তোমার বাবাকে বলব। মাকে বলব।
তিথি টেলিফোন হাতে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। সে এসব কি শুনছে!
হ্যালো তিথি হ্যালো।
শুনছি।
তোমার মাকে টেলিফোন দাও। তার সঙ্গে আমার কথা আছে।
মাকে সব বলবে?
অবশ্যই বলব। কিছুই বাদ দেব না। ইনক্লডিং দ্যা রেড বিউটি স্পট।
তোমার বলতে লজ্জা করবে না?
না। তুমি পাশে থাক। দেখ কি সুন্দর করে বলি। যদি সাহস থাকে তাহলে ডেকে দাও তোমার মাকে।
ধরে থাক, আমি ডেকে দিচ্ছি।
গুড। ভেরী গুড। একসেলেন্ট। আছে তোমার সাহস আছে।
তিথি তার মাকে ডেকে নিয়ে এল। নিজেও দাঁড়িয়ে রইল মার পাশে। শায়লা রিসিভার কানে নিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। এক সময় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন।
তিথি বলল, কি বলল?
শায়লা বললেন, কিছুই তো বলেনি, শুধু কাঁদছিল। এতক্ষণ শুধু কান্নার শব্দ শুনলাম।
কাঁদছিল?
হ্যাঁ। বেচারার কান্না শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেছে। তিথি, তুই কি আরেকবার ভেবে দেখবি?
তিথি বলল, না। ওর অনেক কৌশল আছে। কান্নাটাও এক ধরনের কৌশল। তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় কাদবে। বাবার সঙ্গে কথা বলার সময় অন্য কিছু বলবে। আমি একজন সাধারণ মানুষকে বিয়ে করতে চাই মা, যে কোন রকম কৌশল জানে না।
রাত এগারোটার মত বাজে
রাত এগারোটার মত বাজে।
তিথিদের বাসা শান্ত হয়ে আছে। ইরা-মীরা তাদের ঘরে, দরজা বন্ধ। আলো নেভানো। হয়ত শুয়ে পড়েছে। কিংবা হয়ত ঘর অন্ধকার করে চুপচাপ দুবোন বসে আছে।
জাফর সাহেব বসে আছেন বারান্দায়। বারান্দার বাতিও নেভানো। এই বাড়ি আজ এক অভিশপ্ত বাড়ি। আজ রাতে এই বাড়ির একটি মেয়ের বিয়ে হবার কথা ছিল। এই বাড়িতেই বাসর হবার কথা ছিল।
তিথি খুব কাঁদছে। তার হাতে তার নীল তোয়ালে। তিথির সমস্ত দুঃখ ধারণ করার ক্ষমতা কি এই সামান্য নীল তোয়ালের আছে?
শায়লা মেয়ের পিঠে হাত রেখে মূর্তির মত বসে আছেন। এই ঘরের বাতিও নেভানো। অন্ধকারই ভালো। দুঃখের রাত তো অন্ধকারই হবে।
ভেজানো দরজায় টুক টুক করে শব্দ হল। নুরুজ্জামান ভীত গলায় বলল, মা, একটু শুনবেন?
শায়লা বের হয়ে এলেন। নুরুজ্জামান বলল, রাত দেড়টার সময় একটা ট্রেন আছে। আমি চলে যাব। যাবার আগে আপনার পা ছুঁয়ে একটু সালাম করতে চাচ্ছিলাম।
নুরুজ্জামান নিচু হয়ে সালাম করল। শায়লা বললেন, দুঃখের দিনে চলে যাচ্ছ। আচ্ছা যাও। থেকেই বা কি করবে। আবার কোন দিন যদি মেয়ের বিয়ে ঠিক হয় তোমাকে খবর দেব, তুমি এসো।
জি আচ্ছা। আমি কি তিথির সঙ্গে একটু কথা বলব মা? যদি অনুমতি দেন।
অনুমতির কি আছে? তিথি কথা বলবে কি না সেটাই হল কথা। এসো, ভেতরে এসো।
নুরুজ্জামান ঘরে ঢুকলো।
শায়লা বললেন, তিথি, নুরু চলে যাচ্ছে। তার কাছে বিদায় নিতে এসেছে–বলে তিথির ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। মনে হচ্ছে নুরুজ্জামান একা কিছু কথা বলতে চায়। বলুক।
তিথি ধরা গলায় বলল, আপনি আবার আসবেন। সিলেটে যাবার সময় আপনাকে অপমান করেছি। কিছু মনে রাখবেন না। সে রাতে আপনি যেমন কষ্ট পেয়েছিলেন। আমিও কষ্ট পেয়েছিলাম।
নুরুজ্জামান বলল, আমি কিছু মনে করি নি। আমি অতি সামান্য মানুষ। এই সামান্য মানুষকে আপনারা যে ভালবাসা দেখিয়েছেন তা আমি সারাজীবন মনে রাখব। আমি আপনাকে ছোট্ট একটা কথা বলতে চাই। বলব?
বলুন।
মারুফ সাহেব যে কাজগুলি করেছেন, আপনাকে ভালবাসেন বলেই করেছেন। আজ যদি তাকে আপনি দূরে সরিয়ে দেন তাহলে সবচে বড় কষ্টটা হবে আপনার আপনি কোনদিনই মানুষটাকে ভুলতে পারবেন না। বনের পাখি উড়ে যায় কিন্তু মায়া পড়ে থাকে। মায়ার কষ্ট ভয়ংকর কষ্ট।