তিথি বলল, কি হয়েছে মামা?
বোস এখানে। দরজাটা ভিজিয়ে দিয়ে এসে বোস।
তিথিকে দরজা বন্ধ করতে হল না। শায়লা নিজেই উঠে দরজার হুড়কা লাগিয়ে দিলেন। সাইদুর রহমান সাহেব মুখের পাইপ টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, কি বলছি মন দিয়ে শোন। তোর বাবা আমাকে তোর পাসপোর্ট দিয়ে বলেছিল তুই যেন মারুফ ছেলেটার সঙ্গে এক সঙ্গে বাইরে যেতে পারিস সেই ব্যবস্থা করে দেবার জন্যে। আমি খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি মারুফ ছেলেটার বাইরে যাবার কোন ব্যাপার নেই। এটা তোকে সে মিথ্যা বলেছে।
তিথি তাকিয়ে রইল। সে কিছুই বলল না।
সাইদুর রহমান সাহেব বললেন, সঙ্গত কারণেই আমি খুব চিন্তিত বোধ করলাম। আমরা জানি তোর বাবা মা কোন খোঁজ খবর করবে না। ওরা ঝগড়া ছাড়া অন্য কিছু পারে না। খোঁজ নিয়ে আরো কিছু জিনিস জানলাম।
তিথি কঠিণ গলায় বলল, কি জানলে?
তোর বাবা বলছিল ছেলের বাবা কলেজে অঙ্কের প্রফেসর ছিল। আমি যা জেনেছি তা হল ঐ লোকের নেত্রকোনা শহরে একটা দরজির দোকান আছে। সে দরজি।
তিথির মুখ ছাইবর্ণ হয়ে গেল। জাফর সাহেব মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যথিত গলায় বললেন, ছেলের বাবা কি করেন সেটা কোন ব্যাপার না।
সাইদুর রহমান সাহেব বললেন, তোমার কাছে হয়ত কোন ব্যাপার না। আমার কাছে ব্যাপার। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হবার আগেই বিয়ে বন্ধ হওয়া দরকার —আমার যা বলার বললাম। বাকি তোমাদের বিবেচনা। আমি তিথিকেই জিজ্ঞেস করছি। তিথি তুই কি চাস? বিয়ে হবে?
তিথি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, না।
গুড গার্ল। কিছু কিছু সময় আসে যখন মানুষকে শক্ত হতে হয়।
জাফর সাহেব বললেন, শোনা কথার উপর নির্ভর করে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত না। তিথি তুই মারুফের সঙ্গে কথা বল। চল আমি তোকে নিয়ে যাই।
তিথি বলল, না।
হুট করে বিয়ে ঠিক করা যেমন কাজের কথা না, বিয়ে ভাঙাও তেমন কাজের কথা না।
তিথি কঠিন গলায় বলল, বাবা, আমি মন ঠিক করে ফেলেছি।
মন ঠিক করেছিস ভাল কথা। এক্ষুণি ঠিক করতে হবে তা তো না। সময় নে–ঠাণ্ডা মাথায় ভাব। ওর সঙ্গে কথা বল …
সাইদুর রহমান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, জাফর, তুমি অকারণে ঝামেলা করছ কেন? দেখছ না মেয়েটা মনস্থির করে ফেলেছে? সব কিছুর মূলে আছ তুমি। বাবা হিসেবে তোমার কি দায়িত্ব ছিল না খোঁজ-খবর করার? একজন এসে বলল, আমি শাহজাদা, ওমি তুমি তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেললে? একবার ভাবলেও না সে সত্যি শাহজাদা না ভয়ংকর কোন হারামজাদা?
তিথি উঠে চলে গেল। বড় মামার কুৎসিত ধরনের কথা তার ভাল লাগছে না।
প্রথমে সে গেল নিজের কামরায়। ইরা-মীরা ঘরের খাটে বসে ছিল। আপাকে ঢুকতে দেখে দুজন এক সঙ্গে বের হয়ে গেল। তারাও মনে হয় পুরো ঘটনাটা জানে।
তিথির কেমন যেন অস্থির লাগছে। কিছুক্ষণ কাঁদতে পারলে ভাল হত। কান্না আসছে না। কেমন যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। প্রচণ্ড দুঃখের সময় মানুষের কি ঘুম পায়? এই পরিচিত শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে গেলে কেমন হয়? অনেক দূরে–যেখানে কেউ তাকে চিনবে না। কেউ এসে বলবে না–তিথি, তোমার না বিয়ে হওয়ার কথা ছিল?
বাবার জন্যে তিথির খুব খারাপ লাগছে। কি রকম অদ্ভুত চোখে তিনি সবার দিকে তাকাচ্ছিলেন। তার চোখ ভর্তি বিস্ময়। ঘটনাটার পর মা একবারও তার দিকে তাকাননি। সব সময় চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে ঢেখেছেন। তিথি লক্ষ্য করছে, মা মাঝে মাঝে শাড়ির আঁচলে চোখ চেপে ধরছেন। মা খুব শক্ত মহিলা। মাকে তিথি খুব কম কাঁদতে দেখেছে। এই প্রথম খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে মাকে সে দুবার কাঁদতে দেখল। দুবারই সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে।
আপা?
তিথি দেখল ইরা ঘরে এসে ঢুকেছে। সেও তার দিকে তাকাচ্ছে না। মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে।
কিছু বলবি?
তোমার একটা টেলিফোন এসেছে আপা। তুমি কি ধরবে?
না।
ইরা প্রায় ফিসফিস করে বলল, মা টেলিফোন ধরতে বলছে। তিথি বলল, কার টেলিফোন, মারুফের?
হুঁ। মা তোমাকে কথা বলতে বলল।
মা বললে তো হবে না। আমার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আর শোন–তুই এমন মেঝের দিকে তাকিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছিস কেন? আমি কি এমন কুৎসিত প্রাণি যে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলা যাবে না।
সরি আপা।
ইরা চলে যাচ্ছিল, তিথি বলল, দাড়া আমি টেলিফোন ধরব।
তিথি টেলিফোন ধরতেই ওপাশ থেকে মারুফের খুশিখুশি গলা শোনা গেল।
হ্যালো, তিথি ভাল আছ?
আছি।
গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে ভাল নেই। রাতে ভাল ঘুম হয়েছে?
হ্যাঁ।
আমার হয়নি। বলতে গেলে আমি স্লীপলেস নাইট কাটিয়েছি। ও আচ্ছা, পরে বলতে ভুলে যাব–আমি তোমার ঐ লোক–নুরুজ্জামান–তার জন্যে। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি কিছুদিনের মধ্যে বাইরে যাবেন, ওখান থেকে ফিরবেন মাসখানিক পর। তখন দেখা করতে বলেছেন। আমি ঠিক করেছি তখন নুরুজ্জামানকে সঙ্গে করে নিয়ে ওর কাজ করিয়ে দেব।
তিথি বলল, সাত দিনের মধ্যে তোমার তো বাইরে যাবার কথা–এক মাস পর তুমি নুরুজ্জামান সাহেবের কাজ কিভাবে করিয়ে দেবে?
ও মাই গড! বিয়ের টেনশানে সব এলোমেলো হয়ে গেছে। আমি নিজেই যে থাকব না সেটাই ভুলে গেছি। হা হা হা। যাই হোক, আমি ব্যবস্থা করে যাব। আমি
থাকলেও কাজ আটকাবে না।
তোমার বাবা কি ঢাকায় আছেন?
এখন নেই, কাল আসবেন।
উনি তো তোমাদের ওখানকার কলেজের অংকের প্রফেসর। তাই না?
আমাদের এখানের না। বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অংকের প্রফেসর ছিলেন। সেই আমলে অংকে অনার্স নিয়ে এম. এ. পাশ করেছিলেন। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি। এম. এ.-তে তিনি এবং নরেশ গুহ দুজন এক সঙ্গে প্রথম হন। বাবা মুসলমান বলে কোন চাকরি পাচ্ছিলেন না। সেই নরেশ গুহ কিছুদিন আগে যাদবপুর ইউনিভার্সিটির অংকের হেড অব দি ডিপার্টমেন্ট হিসেবে রিটায়ার করেছেন। এর নাম ভাগ্য।