এখনো তুই পুরোপুরি আমার। বিয়ে হয়ে গেলেতো এই কথাটা বলতে পারব। আয় মা শুয়ে থাক।
শায়লা বসলেন। তিথি তাঁর কোলে মাথা রেখে কোমর জড়িয়ে শুয়ে রইল। শায়লার চোখ দিয়ে ফেঁটা ফোঁটা পানি তিথির গালে পড়ছে। তিথি বলল, মা তুমি কি জান এই পৃথিবীতে আমি তোমার চেয়েও যাকে ভালবাসি সে কে?
জানি। তোর বাবা।
হ্যাঁ। তুমি আমার এই বাবাটাকে কেন কষ্ট দাও? তারচে ভালমানুষ কি তুমি এখন পর্যন্ত আর কাউকে দেখেছ? সত্যি করে বল।
না।
তাহলে কেন এমন কষ্ট দাও। তুমি আজ আমাকে ছুয়ে প্রতিজ্ঞা করবে বাবাকে কষ্ট দেবে না। আমিতো থাকব না, বাবাকে দেখার কেউ থাকবে না। এই জন্যেই তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে বলছি।
আচ্ছা যা প্রতিজ্ঞা করলাম। মাঝে মাঝে এমন বিরক্ত করে যে অসহ্য লাগে।
যত অসহ্যই লাগুক আর তুমি বাবাকে কষ্ট দেবে না।
আচ্ছা যা দেব না।
কিছুক্ষণ আগে শুনলাম নুরুজ্জামান সাহেবকে তুমি কঠিন গলায় বকাবকি করছ। কেন মা?
আরে ওকে বলেছি আজ বাড়িতে লোকজন আসবে ভাল একটা কাপড় পরতে। সে একটা হলুদ কোট গায়ে দিয়ে ঘুরছে। গলায় মাফলার।
বেচারার কোটিটা খুব পছন্দ। তুমি উনাকে একটা ভাল কোট কিনে দাও।
তোকে বলতে হবে না। আগেই ঠিক করে রেখেছি। রেডিমেড স্যুট পাওয়া যায় ঐ একটা কিনে দেব।
উনাকে তোমার খুব পছন্দ হয়েছে তাই না মা?
পছন্দ হবে না কেন? ভাল ছেলে ঘোর প্যাঁচ নাই।
উনাকে কেন পছন্দ হয়েছে সেই রহস্য কিন্তু আমি জানি না।
কি রহস্য?
উনি তোমাকে মা ডাকেন এই জন্যেই তাকে তোমার এত পছন্দ।
মা ডাকলেই পছন্দ করতে হবে না-কি? মাতে কতজনই আমাকে ডাকে। দুনিয়ার যত ফকির সবই আমাকে মা ডাকে। ওদের আমি পছন্দ করি?
তাহলে কেন পছন্দ কর উনি বোকা বলে? পথিবীর বেশির ভাগ মানুষ বুদ্ধিমানদের দুচোখে দেখতে পারে না। বোকাদের তারা পছন্দ করে।
উদ্ভট উদ্ভট কথা বলিসনা তো মা। ও বোকা এটা তোকে কে বলল?।
বোকা তো বলতে হয় না। কপালে লেখাও থাকে না। বোঝা যায়। তিনি আমার। বিয়ের কার্ড শিক্ষামন্ত্রীকে দিয়ে এসেছেন। বিয়েতে দাওয়াত করে এসেছেন। একজন বোকা লোক ছাড়া এই কাজ কে করবে? আবার ইরা মীরাকে এসে বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী নাকি বিয়েতে আসবেন। তাকে কথা দিয়েছেন। হি হি হি।
তিথি হাসছে। শায়লাও হাসছেন। তিথি হাসি থামিয়ে বলল, মা তুমি নুরুজ্জামান সাহেবকে পাঠাওতো আমি জিজ্ঞেস করি মন্ত্রী সাহেব উনাকে কি বললেন।
থাক বেচারাকে লজ্জা দিতে হবে না।
লজ্জা দেব না মা। এম্নি কথা বলব। উনাকে আমার নিরিবিলিতে কয়েকটা কথা বলা দরকার। পাঠাও একটু। আর শোন মা–আমি একটু চা খাব।
তিথি আসলে এক ধরনের অপরাধ বোধে ভুগছে। ঢাকা থেকে সিলেট যাবার সময় মানুষটাকে এক অর্থে অপমানই করা হয়েছে।
মারুফ যখন ট্রেনের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছিল তখন সে কি রকম অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। অবাক এবং বিস্ময়। না না বিস্ময় না সে তাকিয়েছিল ব্যথিত চোখে। এই ব্যথা দূর করে দেয়া দরকার।
নুরুজ্জামান লজ্জিত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল।
তিথি বলল বসুন নুরুজ্জামান সাহেব। চেয়ারটায় বসুন। কেমন আছেন?
ভাল।
মন্ত্রীর কাছে না-কি গিয়েছিলেন?
জি। উনার পিএ প্রথমবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। পরের বার আর কিছু লাগে নাই।
কাজ হয়েছে আপনার?
জ্বি। স্কুল স্যংশনের অর্ডার হয়েছে।
বলেন কি?
মানুষদের মধ্যে যেমন ভাল মন্দ আছে। মন্ত্রীদের মধ্যেও তেমন ভাল মন্দ আছে। উনি আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করলেন তার তুলনা নেই।
শুনে ভাল লাগল। আমরাতো সারাক্ষণ মানুষ সম্পর্কে মন্দ কথাই শুনি।
নুরুজ্জামান ইতস্ততঃ করে বলল, আমি উনাকে মারুফ সাহেবের স্কলারশীপের ব্যাপারটাও বললাম।
তিথি বিস্মিত হয়ে বলল, আপনাকে কে বলতে বলল?
না কেউ বলেনি। আপনি মাকে বলছিলেন–নো অবজেকশান দিচ্ছে না। শুনে মনটা খারাপ হয়েছে। তারপর ভাবলাম সুযোগ যখন পাওয়া গেছে তখন বলে ফেলি।
উনি কি বললেন সব ঠিক করে দেবেন?
উনি সঙ্গে সঙ্গে কাগজ পত্র আনালেন।
তারপর?
উনি বললেন ফ্রান্সের স্কলারশীপের কোন কাগজপত্ৰতো ফাইলে নেই। উনার ধারণা কোথাও কোন ভুল হয়েছে। উনি বললেন আমি যেন ঠিক ঠাক ইনফরমেশন জোগার করে তাকে দেই কিংবা মারুফ সাহেবকে তাঁর কাছে নিয়ে যাই। আমি মারুফ সাহেবের কাছে গেলাম। উনি আবার সব শুনে আমার উপর খুব রাগ করলেন।
রাগ করে কি বলল?
নুরুজ্জামান চুপ করে রইল। মারুফ রাগ করে যে সব কুৎসিত কথা বলেছে তা তার বলতে ইচ্ছা করছে না। তিথি বলল, আপনি ওর কথায় রাগ করবেন না। ওর স্বভাবই এমন। ও কারোর কাছ থেকে সাহায্য নিতে চায় না।
আমি রাগ করিনি। উনার যাবার ব্যাপারে যেন কোন সমস্যা না হয় এই জন্যেই আমি …।
ওর কোন সমস্যা হবে না। আর সমস্যা হলে ও নিজেই তা মেটাবে।
জি আচ্ছা।
আপনি যে কাজে এসেছেন সেটা যে ভালমত হয়েছে তাতেই আমি খুশি। কি নাম যেন আপনার স্কুলের?
বেগম রোকেয়া গার্লস হাই স্কুল।
স্কুল তৈরি হোক। চালু হোক। তারপর একদিন আপনার স্কুল দেখে আসব।
জি আচ্ছা।
মীরা ঘরে ঢুকল চা নিয়ে। চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, বড় মামা এসেছেন। আপা তোমাকে ডাকছেন। মার ঘরে বসে আছেন।
তিথির বড় মামার মুখ অন্ধকার। তিথি অবাক হয়ে দেখল শুধু যে মামার মুখ অন্ধকার তাই না। বাবা মা দুজনের মুখই অন্ধকার। মার শরীর কাঁপছে। বাবা বসে আছেন মাথা নীচু করে।