নামের বানানেই ভুল। আসল জায়গাতেই গণ্ডগোল–এটা তোমার চোখে পড়ল না। এতগুলো টাকা খরচ করলে একটা ভুল কাজে?
ঠিক করে দেব।
কি ভাবে ঠিক করবে?
নুরুজ্জামান ঠিক করে দেবে বলেছে।
সে কি ভাবে ঠিক করবে?
জানি না। বলেছেতো ঠিক করে দেবে।
তিথির আনন্দ লাগছে এই কারণে যে বাবা-মার ঝগড়া নেই। তাঁদের দেখে মনে হচ্ছে না কোন কালে তাদের কোন সমস্যা ছিল। তিথি মাকে নিয়ে বাসায় ফিরে দেখে বাসা খালি। জাফর সাহেব খাবার টেবিলের উপর চিঠি রেখে গেছেন। চিঠিতে লেখা
শায়লা,
তুমি যেহেতু চাচ্ছ না আমি এ বাড়িতে থাকি সেহেতু চলে গেলাম। মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে প্রয়োজন মনে করলে আসব। আমার ঠিকানা হল–৩১ কলতা বাজার।
শায়লা তৎক্ষণাৎ স্বামীর ঘেঁজে গেলেন। তিথি সঙ্গে যেতে চাচ্ছিল, তাকে নিলেন না। ঠিকানা খুঁজে পেতে সমস্যা হতে পারে ভেবে নুরুজ্জামানকে সঙ্গে নিলেন। এবং ঘণ্টা খানিকের মধ্যে জাফর সাহেবকে নিয়ে ফিরে এলেন। তিথি তার ২৩ বছরের জীবনে বাবাকে এত আনন্দিত দেখেনি। অবশ্যি ক্রমাগত বাবাকে ধমকে যাচ্ছেন। কিন্তু জাফর সাহেব কিছুই গায়ে মাখছেন না। বরং তাঁর ভাব দেখে মনে হচ্ছে স্ত্রীর বকা খেতে তার খুব ভাল লাগছে।
সবচে বড় পরিবর্তন যা হয়েছে তা হল এ বাড়িতে নুরুজ্জামানের অবস্থান। শায়লা শুরু থেকেই তাকে এ বাড়ির একজন সদস্য হিসেবে নিয়েছেন। সেও ক্রমাগত বকা খাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই তিথি শুনল মা নুরুজ্জামানকে বকছেন— বুঝলে নুরুজ্জামান, এই পৃথিবীতে তোমার মত এবং তিথির বাবার মত অপদার্থ আমি এখনো দেখিনি। তোমরা দুজনই একপদের। তোমাকে আমি কি বলেছিলাম? রেন্ট এ কার থেকে সারাদিনের জন্যে একটা গাড়ি ভাড়া করতে বলেছিলাম। দাওয়াতের চিঠি বিলি করতে হবে। গাড়ি ভাড়া করেছ?
জ্বি না।
কেন করনি জানতে পারি?
দাওয়াতের চিঠিতে বানান ভুল। এইগুলা ঠিক করে তারপর যাব।
সেই ঠিকতো তুমি সকাল থেকে করছ। কতক্ষণে শেষ হবে? হাসছ কেন? যখন তখন বোকার মত দাঁত বের করে হাসবে না।
জি আচ্ছা।
আমার সামনে থেকে যাও তো। গরমের মধ্যে এই হলুদ কোটটা গায়ে দিয়ে আছ কেন? এটা গা থেকে খোল। আর কোন দিন যেন এই যন্ত্রণা গায়ে না দেখি।
জি আচ্ছা।
নুরুজ্জামান গভীর মনোযোগে বানান ভুল ঠিক করছে। তাকে সাহায্য করছে মীরা এবং ইরা। প্রথমে হোয়াইট ইংক দিয়ে একটা ত মুছে ফেলা হচ্ছে। মীরা ও হরার দায়িত্ব হচ্ছে ফুঁ দিয়ে দিয়ে কালি শুকানো। কালি শুকানোর পর ত টাকে চায়নিজ ইংক দিয়ে থ করা হচ্ছে। এই কাজটি করছে নুরুজ্জামান। কাজটা খুব সাবধানে করতে হচ্ছে। যেন ছাপার অক্ষরের মত দেখা যায়। কালি লেপটে না যায়।
ইরা বলল, নুরুজ্জামান ভাই আপনি না থাকলে আমাদের কি যে সমস্যা হত। আপনি থাকায় মার রাগটা দুভাগ হয়ে বাবার এবং আপনার উপর পড়ছে। আপনি না থাকলে অর্ধেকটা রাগ আমার আর মীরার উপর পড়তো। বড় আপার উপরতে মা এখন রাগ করতে পারবে না। তার বিয়ে হচ্ছে। ঠিক বলছিনা নুরুজ্জামান ভাই?
নুরুজ্জামান বলল, কথা বলবে না কাজ কর।
জাফর সাহেব তিথির পাসপোর্ট নিয়ে এসেছেন। এখন ভিসার ব্যাপারটা ঠিক করতে পারলে তিথিকে মারুফের সঙ্গেই পাঠিয়ে দেয়া যায়। হাতে বেশ কিছু ডলার দিয়ে দিতে হবে। যাতে বিদেশের মাটিতে পা দিয়েই বিব্রত হতে না হয়। জাফর সাহেব প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে ডলার করার জন্যেই এক লাখ কুড়ি হাজার টাকা তুলেছেন। এতে প্রায় তিন হাজার ডলার হবে। এত ডলার কি ভাবে সঙ্গে দেয়া যায় সেও সমস্যা। মারুফের সঙ্গে ব্যাপারটা আলাপ করা দরকার। তাকে পাচ্ছেনও না। সেও বোধহয় ছুটোছুটির মধ্যে আছে।
মারুফের বাবার সঙ্গে তার এখনো কথা হয়নি। অথচ কথা বলা খুব দরকার। শুধু যে মারুফের বাবার সঙ্গেই কথা হয়নি তা না, তার আত্মীয় স্বজন কারোর সঙ্গেই কথা হয়নি।
গতকাল মারুফের দূর সম্পর্কের এক চাচা-চাচী এসেছিলেন দুজনই বেশি কথা বলেন। স্ত্রী কোন কথা বলতে গেলে স্বামী তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কথা শুরু করেন। আবার স্বামী কিছু বলতে গেলে স্ত্রী আগ বাড়িয়ে তা বলে ফেলেন। তাদের সঙ্গে কাজের কথা কিছুই হয়নি। অথচ অনেক কিছু বলার আছে। মারুফের সঙ্গে সিটিং হওয়া দরকার। তাকে পাওয়াই যাচ্ছে না। নুরুজ্জামানকে দিয়ে তার ঘরে চিঠি লিখে ফেলে রাখা হয়েছে। চিঠিতে অবিলম্বে বাসায় এসে দেখা করতে বলা হয়েছে। তাতেও লাভ হচ্ছে না। সে আসছে না।
জাফর সাহেব ভেবে রেখেছেন গভীর রাতে নুরুজ্জামানকে নিয়ে একবার যাবেন। নুরুজ্জামানকেও পাওয়া যাচ্ছে না। সে চরকির মত ঘুরছে। একটা বিয়ে বাড়ির কাজতো অল্প না। হাজারো কাজ। মজার ব্যাপার হল জাফর সাহেব তেমন কোন কাজ পাচ্ছেন না। তিনি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ঘরে বসে আছেন। অথচ করার কিছু নেই। কমুনিটি সেন্টার ভাড়ার ব্যাপারটা নিজে করতে চেয়েছিলেন, শায়লা ধমক দিয়েছেন তুমি চুপ করে থাকতো। এসবের তুমি কি বোঝ?
বিয়ের ব্যাপারটা তিথির বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয় স্বজনরা এখনো কেউ জানেন। তিথি কাউকেই জানায়নি। মারুফের বিশেষ অনুরোধ ছিল যেন জানানো না হয়। মারুফের এ ব্যাপারটাও তিথি বুঝতে পারছে না। কেন কাউকে জানানো হবে না। বিয়ে নিশ্চয়ই কোন সামাজিক অপরাধ না যে কাউকে বলা যাবে না চুপি চুপি সারতে হবে। মারুফের যুক্তি হচ্ছে, বিয়ে শুধু মাত্র দুজনের ব্যাপার। এই দুজনের বাইরে কারোর কিছু নয়। কাজেই ঢাক ঢোল পিটালো কেন? তা ছাড়া সে এই বিয়েতে কিছু দিতে পারছে না। লোকজন এসে দেখবে ফকিরি বিয়ে। কি দরকার?