নুরুজ্জামান উঠে দাঁড়াল। মারুফ বলল, চলে যাচ্ছেন না কি? দয়া করে চলে যাবেন না। আপনি চলে গেলে আমরা এতিম হয়ে পড়ব।
নুরুজ্জামান বলল, আমি আপনার জন্যে খাবার নিয়ে আসি। কি খাবেন বলুন? বিষ পাওয়া যায় কিনা দেখুন। ব্যাটম হলে সবচে ভাল হয়।
নুরুজ্জামান নেমে গেল। তিথি বলল, তুমি এই লোকটাকে নিয়ে রসিকতা করছিলে। আমার ভাল লাগছিল না।
আমারও ভাল লাগছিল না। কি করব বল–রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। রসিকতা করে রাগটা একটু কমালাম। তবে লোকটা নির্বোধ না। ভালবাসার ব্যাখ্যা ভালই দিয়েছে। এখন বল তো তিথি, এই ব্যাটার হাত থেকে কি করে উদ্ধার পাওয়া যায়?
জানি না।
একটা বুদ্ধি বের কর।
তিথি চুপ করে থাকল। আসলেই তার মাথা ধরে গেছে। কপাল দপদপ করছে। জ্বর আসছে কি না কে জানে, শীত শীত লাগছে। মারুফ বলল, একটা কাজ যদি কর তাহলে কিন্তু এই গাধা বিদেয় হবে।
কি কাজ?
তুমি যদি তাকে কঠিন করে বল–আপনি আমাদের যথেষ্ট বিরক্ত করেছেন–এখন চলে যান। আমরা এখন দরজা বন্ধ করে গল্প করব। পারবে বলতে?
না।
তোমাকে বলতেই হবে। না বললে হবে কি ভাবে? এমন সুন্দর একটা ব্রত আমরা নষ্ট করব? তাকিয়ে দেখ কি সুন্দর জোছনা।
তিথি চুপ করে আছে। মারুফ বলল, এই লোক কি করবে জান? এ আমার জন্যে খাবার আনবে, সেই সঙ্গে পাতা নিয়ে আসবে বাঁশি বাজানোর জন্যে। পাতার বাঁশি বাজিয়ে সে তোমাকে মুগ্ধ করতে চাইবে।
কেন?
আমার তাই মনে হচ্ছে। এবং আমার ধারণা বাঁশি ভালই বাজাবে। তুমি মুগ্ধ হয়েও যেতে পার।
পাগল হলে না-কি?
বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছি। এই লোক আর কিছুক্ষণ থাকলে আমি সত্যি পাগল হয়ে যাব। শোন তিথি–তুমি এই লোককে যদি চলে যেতে না বল তাহলে আমি নিজে চলে যাব। তিনজন এই কামরায় বসে থাকার কোন অর্থ হয় না।
নুরুজ্জামান খাবার নিয়ে এসেছে। লুচি, মিষ্টি, কলা। মারুফ বলল, পাতা কোথায়?
কিসের পাতা?
পাতা ছাড়া বাঁশি বাজাবেন কি ভাবে? পাতা আনেন নি?
জ্বি না।
ও মাই গড়! কৃষ্ণের বাঁশি ছাড়া আমরা এই দীর্ঘ রজনী পার করব কি ভাবে?
নুরুজ্জামান তাকিয়ে আছে। তার চোখের তারায় চাপা রাগ ঝিলিক দিচ্ছে। সে খাবার নামিয়ে রাখছে। মারুফ বলল, তিথি বোধহয় আপনাকে কিছু বলবে, শুনুন তো। মন দিয়ে শুনবেন। তিথি, তুমি কি জানি বলতে চাচ্ছিলে, বলে ফেল।
তিথি বলল, নুরুজ্জামান, আপনি এখন চলে যান। ভোরবেলা ট্রেন যখন থামবে তখন আসবেন।
নুরুজ্জামান খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, জ্বি আচ্ছা।
নুরুজ্জামান বাইরে এসে দাঁড়াতেই মারুফ ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। মারুফ বলল, তিথি শোন, তুমি আপসেট হয়ো না। আমি কিছুক্ষণের জন্যে বাতিটা নিভিয়ে দিচ্ছি। বাতি নিভিয়ে আমি ঐ লোককে একটা ম্যাসেজ দিতে চাই। তা ছাড়া বাতি না. নেভালে সুন্দর চাদের আলো আমরা পাব না।
তিথি কিছু বলার আগেই মারুফ বাতি নিভিয়ে দিল।
নুরুজ্জামান মিনিট পাঁচেক বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্ত পায়ে চলে গেল।
শায়লা অবাক হয়ে বললেন
শায়লা অবাক হয়ে বললেন, তুই কোত্থেকে?
তিথি বলল, তোমাকে নিতে এসেছি মা। স্যুটকেস গুছিয়ে নাও। আজ দুপুরে একটা ট্রেন আছে ঢাকা যাবে।
তুই হড়বড় করিস না তো। তোর সাথে এটা কে?
ইনার নাম নুরুজ্জামান। ইনি পাতার বাঁশি বাজান। ইনি আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে এসেছেন।
তোর হড়বড়ে কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে।
মাথা আরো গুলিয়ে যাবে যখন আসল কথা শুনবে।
আসল কথা কি?
আসল কথা হল আমার বিয়ে। বিয়ের তারিখ তোমার অনুপস্থিতিতেই মোটামুটি ঠিক করা হয়েছে–আসছে বৃহস্পতিবার। যার সঙ্গে বিয়ে তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। সে সরাসরি তোমার সামনে আসতে ভরসা পাচ্ছে না বলে বেবীটেক্সিতে বসে আছে। তুমি যদি ভরসা দাও তাহলে তাকে নিয়ে আসতে পারি। মা আনব?
শায়লা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার মাথা সত্যি সত্যি এলোমেলো হয়ে গেছে। তিনি তার নিজের মেয়েকে এত হাসিখুশি কখনো দেখেন নি। হীরক খণ্ডে আলো পড়লে হীরক খণ্ড যেমন ঝলমল করতে থাকে—তিথিও তেমনি ঝলমল করছে। শায়লার চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে–তুই হঠাৎ এত সুন্দর হয়ে গেলি কি ভাবে? কিন্তু তিনি কিছু বলতে পারছেন না। তার কথা বন্ধ হয়ে গেছে।
তিথি বলল, মা, তুমি যেহেতু হ্যাঁ না কিছুই বলছ না তখন ধরে নিচ্ছি তোমার সম্মতি আছে। নুরুজ্জামান সাহেব, আপনি দয়া করে মারুফকে ডেকে আনুন।
শায়লা দেখলেন, নীল রঙের হাওয়াই শার্ট পরা টকটকে ফর্সা একটা ছেলে হাসি মুখে তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এত সুন্দর একটা ছেলে কিন্তু চুল আঁচড়ায়নি কেন?
তিথি বলল, মা, ওর নাম মারুফ। এখন তুমি ইচ্ছা করলে একটা বটি দিয়ে আমাদের দুজনকে কেটে চার টুকরা করে ফেলতে পার, কিংবা আদর করে পাশাপাশি দাড়া করাতে পার। কোষ্টা করবে তুমি ঠিক কর।
মারুফ সালাম করবার জন্যে নিচু হয়েছে। শায়লা কিছুক্ষণের জন্যে পাথরের মূর্তির মত শক্ত হয়ে রইলেন। তারপরই মারুফের মাথায় হাত রাখলেন। তার আরেকবার মনে হল–তিথি কেন লক্ষ্য করে না যে এর চুল আঁচড়ানো নেই।
শায়লা তাকালেন তিথির দিকে। মার হাসি দেখে তিথির চোখ ভিজে উঠছে।
আগামী বৃহস্পতিবার তিথির বিয়ে
আগামী বৃহস্পতিবার তিথির বিয়ে।
মারুফ চাচ্ছিল উৎসব টুসব কিচ্ছু হবে না। উৎসবের কোন দরকার নেই অর্থহীন সামাজিকতা। জাফর সাহেব রাজি হন নি। তাঁর প্রথম মেয়ের বিয়ে। তিনি ক্যুনিটি সেন্টারে বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন। বিয়ের কার্ড ছাপা হয়েছে একদিনে। কার্ডে তিথির নাম ভুল ছাপা হয়েছে তিথির জায়গায় তিতি। এ নিয়ে শায়লার সঙ্গে তাঁর একটা খণ্ড যুদ্ধ হয়ে গেল। যুদ্ধ শায়লা একাই করলেন, জাফর সাহেব যুদ্ধ শুরুর আগেই পরাজয় স্বীকার করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।