নুরুজ্জামান লজ্জিত গলায় বলল, আসলে আমার মাথায় হঠাৎ রক্ত উঠে গেছে। এটেনডেন্টকে জিজ্ঞেস করেছি আপনি চা-টা খেয়েছেন কি-না। সে তখন বলল, এই ঘরে একজন ভদ্রলোক আছেন। তখন …
তিথি শান্ত গলায় বলল, বুঝতে পারছি। আপনি শুধু শুধুই আপসেট হয়েছেন। একজন অচেনা লোক তো আর হুট করে আমার ঘরে ঢুকে যেতে পারবে না। আমি তা দেব কেন?
মারুফ বলল, তিথি, তুমি সত্যি কথাটা ভদ্রলোককে বল। ও চলে যাক।
নুরুজ্জামান বলল, সত্যি কথাটা কি?
মারুফ আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরতে বলল, সত্যি কথাটা হচ্ছে–তিথি আমার স্ত্রী। আমরা গোপনে রেজিস্ট্রি বিয়ে করেছি। দু সীটের এই স্লিপিং বার্থ নেয়া হয়েছে যাতে আমরা নিরিবিলি যেতে পারি। আশা করি ব্যাপারটা এখন বুঝতে পেরেছেন? না কি আপনাকে বিয়ের কাবিন নামা দেখাতে হবে?
নুরুজ্জামান ভয়ংকর অবাক হয়ে তিথির দিকে তাকালো। তিথির দারুণ লজ্জা লাগছে। মারুফ এসব কি বলছে? তিথি অস্বস্তি ঢাকার জন্যে অকারণেই নিজের ব্যাগ খুলল।
মারুফ বলল, তিথি, আমি যে সত্যি কথা বলছি এটা এই ভদ্রলোককে বলে দাও–ও বিদেয় হোক।
তিথি বলল, নুরুজ্জামান সাহেব–আমাদের বিয়ে এখনো হয়নি। তবে এক সপ্তাহের ভেতরই হবে।
ও আচ্ছা।
মারুফ বলল, ও আচ্ছা না। আপনি দয়া করে নিজের জায়গায় যান। আপনার হলুদ কেটি দেখে মাথা ঘুরছে। এই কোট পেয়েছেন কোথায়?
কিনেছি?
এটা যে মেয়েদের কোট তা জানেন?
জ্বি না, জানতাম না।
এখন তো জানলেন। এখন দয়া করে কোটটা গা থেকে খুলে ফেলুন। এবং বিদেয় হোন।
নুরুজ্জামান নড়ল না। বরং তিথি এবং মারুফ দুজনকেই অবাক করে দিয়ে বসল। মারুফ বলল, বসলেন যে! ব্যাপার কি? নুরুজ্জামান জবাব দিল না।
জাফর সাহেব তার উপর দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন। তিথিকে দেখে-শুনে নিয়ে যেতে। সে যে ভাবেই হোক তা করবে। এদের বিয়ে যখন হবে, তখন হবে। এখনও তো বিয়ে হয় নি।
মারুফ বলল, মনে হচ্ছে আপনি যাবেন না?
নুরুজ্জামান বলল, জ্বি, অবশ্যই যাব। এখানে বসে থাকব কেন?
এই তত বসে আছেন।
আপনার জন্যে বসে আছি।
আমার জন্যে বসে আছেন মানে?
আপনি যখন যাবেন তখন আমিও যাব।
মারুফ তিথির দিকে তাকালো। তিথি কিছুই বলল না। মারুফ নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে হাসিমুখে বলল, আচ্ছা আচ্ছা, বসুন। তিনজন মিলেই গল্প করা যাক। আসলে গল্প-গুজব তিনজন ছাড়া জমে না। থ্রি ইজ কোমপেনি। আপনি করেন কি?
আমি একজন শিক্ষক।
তিথি বলছিল আপনি একজন বংশিবাদক। পাতার বাঁশি বাজান।
জ্বি বাজাই।
ভাল। বাজান পাতার বাঁশি। শুনে দেখি। আর যখন কিছুই করার নেই তখন পাতার বাঁশিই শোনা যাক।
পাতা সাথে নাই।
বাঁশি বাজান অথচ সাথে পাতা নেই এটা কেমন কথা? এরপর থেকে সঙ্গে পাতা রাখবেন। কোন স্টেশনে যদি ট্রেন থামে তাহলে দৌড়ে নেমে পাতা নিয়ে আসবেন।
জ্বি আচ্ছা।
তিথি, তুমি চুপ করে আছ কেন? কিছু বল।
আমার মাথা ধরেছে।
একটু কষ্ট কর। কোন এক স্টেশনে ট্রেন থামুক–তখন উনি পাতা নিয়ে আসবেন। সেই পত্রসংগীত শুনে হোপফুলি তোমার মাথাধরা সেরে যাবে। নাম কি যেন আপনার?
নুরুজ্জামান।
লোকজন আপনাকে কি ডাকে? নুরু?
জ্বি। আমি আপনাকে নুরু ডাকলে আপনার আপত্তি আছে?
জ্বি-না।
নুরু!
জ্বি।
ভালবাসা সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত কি?
কি বললেন বুঝতে পারলাম না।
মনে করুন, আপনার স্কুলের ছাত্রদের আপনি ভালবাসা কি এর উপর একটা বক্তৃতা দিচ্ছেন। এদের কি বলবেন?
ইস্কুলে তো এইসব বিষয়ে বক্তৃতা দেয়া হয় না।
মনে করুন, নতুন কারিকুলাম তৈরি হয়েছে। এই কারিকুলামে ভালবাসার উপর বক্তৃতার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তখন কি করবেন? কারিকুলাম শব্দটার মানে জানেন তো?
জানি।
তিথি বলল, তুমি কি সব কথা বলছ? দয়া করে চুপ কর।
চুপচাপ বসে থেকেই বা কি হবে? তারচে বরং আমরা নুরুর কাছ থেকে ভালবাসা কি এটা জেনে নেই। আমার মনে হচ্ছে উনার বক্তৃতা ইন্টারেস্টিং হবে। নুরু, বলুন ভালাবাসা কি?
নুরুজ্জামান বলল, ঘৃণার উল্টোটাই হল ভালবাসা। আমাকে এইখানে বসে থাকতে দেখে আপনার মনে যে ভাব তৈরি হয়েছে এটার উল্টোটাই ভালবাসা।
মারুফ একটু থমকে গেল। হলুদ কেটি গায়ে এই গ্রাম্য মানুষটার মুখ থেকে এ ধরনের কথা আশা করা যায় না। তবে গ্রামের লোক মাঝে-মাঝে চমকে যাওয়ার মত কথা বলে। সেই সব কথাও সাময়িক। আলো পড়লে এক খণ্ড লোহাও মাঝেমধ্যে ঝলসে উঠে। হীরক খণ্ডের সার্বক্ষণিক দ্যুতি লোহার মধ্যে নেই।
নুরু!
জ্বি।
ভালবাসার ব্যাখ্যা তো আপনি উল্টো দিক থেকে করলেন। সরাসরি ব্যাখ্যা করুন তো।
ময়মনসিংহ গীতিকায় ভালবাসা কি তা সুন্দর করে বলা আছে। সেটা বলব?
বলুন।
উইড়া যায়রে বনের পখী পইরা থাকে মায়া।
এখানে ভালবাসা কোনটা—বনের পাখিটা? যে উড়ে চলে গেল?
জ্বী না। বনের পাখি ভালবাসা না। ভালবাসা হল মায়া। পাখি উড়ে গেলেও যেটা থাকে, সেটা।
ট্রেন ভৈরব স্টেশনে থেমেছে। তিথি মারুফের দিকে অকিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল, তুমি খাবারের ব্যবস্থা কর।
মারুফ বলল, দরকার নেই।
দরকার নেই বললে তো হবে না। তুমি সারারাত না খেয়ে থাকবে না-কি?
আমার খিদে নষ্ট হয়ে গেছে।
মোটেই তোমার খিদে নষ্ট হয় নি। মুখ দেখেই মনে হচ্ছে তুমি কষ্ট পাচ্ছ।
খাদ্যের অভাবে আমি কষ্ট পাই না তিথি। আমি কষ্ট পাই ভালবাসার অভাবে।
কথার পিঠে এই চমৎকার বাক্যটি ব্যবহার করতে পেরে মারুফের ভাল লাগছে। সব সময় এ রকম বাক্য মাথায় আসে না। হঠাৎ হঠাৎ আসে।