দরজায় নক হচ্ছে। নুরুজ্জামান এসেছে বোধহয়। তিথি লক্ষ্য করেছে এর মধ্যেই কয়েকবার সে দরজার সামনে দিয়ে হেঁটে গেছে। সে তার দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করছে। তিথিকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে কঠিণ করে বলতে হবে, আপনি বিরক্ত করবেন নাতো। নিজের জায়গায় গিয়ে ঘুমিয়ে থাকুন। প্রয়োজন হলে আমি আপনাকে ডাকব।
তিথি দরজা খুলল।
মারুফ দাঁড়িয়ে আছে। তার কাঁধে পেটমোটা বিশাল এক কালো ব্যাগ। গায়ে নতুন একটা সার্ট। কি সুন্দর তাকে মানিয়েছে। মারুফ বলল, অবাক হয়েছ?
তিথি জবাব দিল না।
মারুফ বলল, তোমাকে অবাক করে দেবার জন্যে এতক্ষণ উদয় হই নি। ঘাপটি মেরে ছিলাম।
তিথি এখনও কথা বলছে না। তাকিয়ে আছে। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে চায়ের কাপ থেকে ছলকে খানিকটা চা পড়ে গেছে তার শাড়িতে।
মনে হচ্ছে অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছ? ভেতরে আসতে পারি?
হ্যাঁ পার।
বসতে পারি?
পার।
এখন সত্যি করে বল তো, তুমি কি মনে মনে আমাকে এক্সপেক্ট করছিলে না?
করিছলাম।
আমাকে দেখে খুশি হয়েছ তো?
হয়েছি।
তোমার মুখে কিন্তু হাসি নেই। হাসিমুখে তাকাও তে। এই তো হাসি এসেছে। গুড গার্ল।
মারুফ দরজা বন্ধ করে দিল। তিথি ক্ষীণ স্বরে বলল, দরজা খোলা থাক না।
মারুফ বলল, দরজা খোলা থাকবে কেন? একটা কামরায় আমরা দুজন আলাদা–এই ব্যাপারটায় তুমি কি অস্বস্তি বোধ করছ? আচ্ছা বল, এটা কি অস্বস্তি বোধ করার মত কোন ব্যাপার? তারপরেও তুমি যদি অস্বস্তি বোধ কর তাহলে বরং একটা প্রতিজ্ঞা করি।
কি প্রতিজ্ঞা?
কঠিন প্রতিজ্ঞা। যে প্রতিজ্ঞা ভাঙা অসম্ভব। তোমার হাত ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা। দেখি ডান হাতটা বাড়াও।
তিথি হাত বাড়াল। মারুফ হাত ধরে, চোখ বন্ধ করে বিড় বিড় করে বলল,
পৃখিবী নামক গ্রহটির সবচে রূপবতী তরুণীর হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করছি–এই কামরায় আমি যতক্ষণ থাকব ততক্ষণ আমি এই রূপবতীর কাছ থেকে খুব কম করে হলেও এক হাত দূরত্ব বজায় রাখব।
তিথি বলল, নাটক করার দরকার নেই। তুমি বস তো আরাম করে।
তাহলে আমি কি ধরে নিতে পারি যে, এই কামরায় রাত কাটানোর অনুমতি পেয়েছি??
চা খাবে? পটে চা আছে।
দাও।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে মারুফ বলল, হলুদ কোট পরা একজনকে দেখলাম তোমার মালপত্র টানাটানি করছে–সে কে?
নুরুজ্জামান।
ও আচ্ছা–আমাদের পাতার বাঁশিবাদক। তোমার চড়নদার?
হুঁ।
যে কোট গায়ে দিয়ে সে ঘুরছে সেটা যে মেয়েদের কোট তা তুমি ওকে বলতে পারলে না?
বেচারা শখ করে কিনেছে। কি দরকার কথা বলার?
মারুফ বলল, তোমার সঙ্গে কি কোন খাবার আছে তিথি? আমি তাড়াহুড়া করতে গিয়ে খেয়ে আসি নি।
আমার সঙ্গে কোন খাবার নেই। তবে এদের বুফে কারে নিশ্চয়ই খাবার আছে।
নেই, খোঁজ নিয়েছি। বোম্বাই টোস্ট নামে কি একটা ভেজে রেখেছে। ওর থেকে ১০১ গজ দূরে থাকা ভাল।
সারারাত না খেয়ে থাকবে?
হ্যাঁ থাকব। সিগারেট ধরাব, তোমার অসুবিধা হবে না তো?
ক্রমাগত সিগারেট খেতে থাকলে অসুবিধা হবে। একটা-দুটা খেলে অসুবিধা হবে না।
একটা মানুষ সারা রাত না খেয়ে থাকবে? তিথির খুব খারাপ লাগছে। কোন স্টেশনে থামলে কলাটলা জাতীয় কিছু কিনতে হবে। নেক্সট স্টপেজ কোথায়–ভৈরব? ভৈরবে থামবে তো? আস্ত নগর ট্রেনগুলি এমন হয়েছে কোথাও থামে না। ট্রেন স্টেশনে না থামলে ভাল লাগে না। স্টেশনে ট্রেন থামবে, চা গ্রাম চা গ্রাম শব্দ হবে। লোকজন উঠবে নামবে। তবেই না মজা।
তিথি বলল, ভৈরবে ট্রেন থামলে তুমি স্টেশনে নেমে কিছু খেয়ে নেবে।
আমার খাওয়া নিয়ে তুমি মোটেই চিন্তা করবে না। না খেয়ে থাকা আমার অভ্যাস আছে।
মারুফ না খেয়ে আছে এটা সত্যি না। সে খাওয়া-দাওয়া করেই ট্রেনে উঠেছে। খাওয়ার কথা বলেছে, কারণ ক্ষুধার্ত মানুষের প্রতি মেয়েদের এক ধরনের বিশেষ মমতা আছে। মমতা তৈরীর এই সুযোগ নষ্ট করা ঠিক হবে না।
তোমার বাবা কেমন আছেন?
ভাল।
এখনো হাসপাতালে?
মনে হয়।
মনে হয় বলছ কেন?
আমার এক মামা আছেন, তাঁকে বলে এসেছি বাবাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করিয়ে বাসায় এনে রাখতে। তবে বাবা বোধহয় রাজি হবেন না। তিনি কোন কিছুতেই রাজি হন না।
বন্ধ দরজায় টোকা পড়ছে। মারুফ বিরক্ত মুখে দরজা খুলে দিল। নুরুজ্জামান দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে রাজ্যের বিস্ময়। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মারুফের দিকে। মারুফ বলল, আপনি কি চান?
নুরুজ্জামান বলল, আপনি কে? আপনি এখানে কেন? এটা রিজার্ভ কামরা। উনি একা যাবেন।
তিথি খুবই অস্বস্তির সঙ্গে বলল, নুরুজ্জামান সাহেব, কোন অসুবিধা নেই।
নুরুজ্জামান কঠিন গলায় বলল, অসুবিধা নেই বললে তো হবে না। অবশ্যই অসুবিধা আছে। এই যে ভাই শুনুন। বের হয়ে আসুন।
নুরুজ্জামান কথা বলছে উঁচু গলায়। তাকে দেখে মনে হচ্ছে এখনই সে সার্টের কলার ধরে মারুফকে বের করে আনবে।
মারুফ বিরক্ত গলায় বলল, আপনি বরং ভেতরে এসে বসে একটু শান্ত হোন। যে হৈ-চৈ শুরু করেছেন ট্রেনের সব যাত্রী চলে আসবে। তিথি, আমার ব্যাপারটা তুমি এই ভদ্রলোককে বুঝিয়ে বল তো। যন্ত্রণা হল দেখি!
তিথি বলল, নুরুজ্জামান সাহেব, ভেতরে আসুন।
নুরুজ্জামান ভেতরে ঢুকল।
দরজা বন্ধ করে দিয়ে বসুন।
আমি বসব না। কি বলবেন বলুন।
বসুন তো।
নুরুজ্জামান বসল না। দাঁড়িয়েই থাকল। তিথি বলল, উনি আমার পরিচিত একজন। তার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। তিনি এক কাপ চা খাবার জন্যে ঘরে এসেছেন। আপনি যা হৈ-চৈ শুরু করেছেন–খুবই অস্বস্তির মধ্যে আমাদের ফেলেছেন।