কি কথার কি উত্তর! কি হয়েছে বাবার?
নুরুজ্জামান মুগ্ধ চোখে চিড়িয়াখানা
নুরুজ্জামান মুগ্ধ চোখে চিড়িয়াখানার জলাধারের পাশে দাঁড়িয়ে। জলহস্তী পরিবারের কাণ্ডকারখানায় সে মুগ্ধ ও বিস্মিত। কিছুক্ষণ পর পর সে বলছে, কি আজিব জানোয়ার। তার ইচ্ছা করছে কলা বা বাদাম কিনে এদের খাওয়ায়। বাইরে সাইনবোর্ড ঝুলছে–চিড়িয়াখানার পশুদের কিছু খাওয়াবেন না। নোটিশ না থাকলে সে অবশ্যই কলা বা এই জাতীয় কিছু কিনে খাওয়াতো। এরা ফল-মূল খায় কিনা কে জানে। পানির জানোয়ার, মাছ খাওয়ারই কথা। তবে পানির জানোয়ার হলেও শুকনাতেও এরা অনেকক্ষণ থাকে। কাজেই সুলভূমির খাবার খেতেও পারে। কাকে জিজ্ঞেস করা যায়? চিড়িয়াখানার লোকজন নিশ্চয়ই জানবেন। নুরুজ্জামান চিড়িয়াখানার লোকজনদের খোঁজে বের করত। তার হাতে সময় বেশি নেই। সন্ধ্যা ৭ টায় মন্ত্রী সাহেবের সঙ্গে এপয়েন্টমেন্ট হয়েছে। পি. এ সাহেবের স্ত্রী ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কথা ছিল–এপায়েন্টমেন্ট হয়ে গেলে পি, এ সাহেব টেলিফোন করে জানাবেন। তা জানান নি। টেলিফোন নাম্বার হারিয়ে ফেলেছিলেন। নুরুজ্জামান আবার খোঁজ নিতে গিয়ে ব্যাপারটা জানল। ভাগ্যিস খোঁজ নিতে গিয়েছিল! মিনিস্টার সাহেবের আবার জাপান চলে যাবার কথা।
জলহস্তী কি খায় এই তথ্য নুরুজ্জামান বের করতে পারছে না। এই পর্যন্ত দুজনকে জিজ্ঞেস করল। প্রথমজন তাকে রীতিমত অপমানই করল। সে বলল, জলহস্তী কি খায় তা দিয়ে আপনার কি দরকার? আপনি কি জলহস্তী?
দ্বিতীয়জন এ জাতীয় অপমান করল না। সে বলল, জানি না। সে বালতিতে করে কুচি কুচি করে কাটা লাউ নিয়ে যাচ্ছে। কাকে খাওয়াবে কে জানে? লাউ কে খায়?
নুরুজ্জামান ঠিক করল আরেকদিন এসে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকবে। এর মধ্যে একসময় না একসময় জলহস্তীকে খাবার দেবেই। তখন দেখে নিলেই হবে। আজ থাকা যাবে না। মিনিস্টার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে হবে। এক্ষুণি রওনা দেয়া দরকার।
শিক্ষামন্ত্রী চৌধুরী নবী নেয়াজ খান বিরক্ত মুখে বসে আছেন। তাঁর আলসার আছে। বিকেলের পর থেকে আলসারের ব্যথাটা জানান দেয়। ব্যথা তেমন তীব্র নয়, তবে অস্বস্তিকর। বিকেল থেকে আলসারের ব্যথার থেকেও তীব্র ব্যথা শুরু হয়। সেটা হল দর্শনার্থীর যন্ত্রণা। দেশটার কি হয়েছে কে জানে? অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আজকাল লোকজন মন্ত্রীর কাছে চলে আসে।
গতকাল একজন এসেছিল–তার টেলিফোনে বিল বেশি হচ্ছে। বিল বেশি হচ্ছে তো তিনি কি করবেন? তিনি টেলিফোনের মন্ত্রী না। তার হল শিক্ষা দপ্তর। শিক্ষা সংক্রান্ত ব্যাপারে তার কাছে আসা যায়। তাও ছোটখাট কিছু নিয়ে না। বড় কিছু–তা আসবে না। তুচ্ছ সব ব্যাপার নিয়ে আসবে–সময় নষ্ট করবে। গত সপ্তাহে একজন আসল ক্লাস ফোরের ধর্ম বইয়ে ভুল আছে এই খবর নিয়ে। একা আসে নি। সঙ্গে বিরাট দল। তুমুল হৈ-চৈ।
স্যার বলুন, আপনি বলুন, আরবিতে কি ভ আছে?
তিনি তাৎক্ষণিকভাবে মনে করতে পারলেন না আরবীতে ভ আছে কি না। মনে মনে আলিফ বে তে ছে পড়তে লাগলেন–
স্যার আপনি বলুন–আছে ভ?
তিনি অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, মূল ব্যাপারটা বলুন।
সূরা নাস-এর বাঙলা উচ্চারণ লিখেছে–মিন শাররিল ওয়াস ওয়াসিল খাসিল লাযি ইউয়াসভিসু ফী সুদূরিন্নাস। দেখুন অবস্থা–ইউয়াসভিসু। লেখা উচিত ইউয়াসফি। ফয়ের জায়গায় হয়েছে ভ।
তিনি বললেন, হুঁ।
জরুরী ব্যবস্থা নিতে হবে স্যার। ছাত্ররা খোদার পাক কালাম ভুল শিখবে–?
তিনি আবারও বললেন, হুঁ।
আপনি স্যার এই বই নিষিদ্ধ করুন। নতুন করে বই ছাপা হবে, তারপর ছাত্ররা পড়বে।
ছোটখাট ভুল তো থাকতেই পারে। শিক্ষকরা সেগুলি শুধরে দেবেন।
আপনি কি বলছেন স্যার! খোদার পাক কালামে ভুল থাকবে? এটা কি স্যার বিবেচনার কথা হল?…
প্রতিদিন এরকম কিছু সমস্যা নিয়ে তাকে সময় নষ্ট করতে হয়। আর শুনতে হয় তদবির। কত ধরনের তদবির নিয়ে লোকজন যে আসে তা আল্লাহ জানেন এবং তিনিই জানেন।
স্থানীয় দারোগা ঘুষ খাচ্ছে। তাকে বদলি করতে হবে।
সেই একই দারোগা অত্যন্ত সৎ। তাকে এখানেই রাখতে হবে।
এজি অফিসে টিএ বিল অটিকে রেখেছে। বিল পাশ করতে হবে।
অমুক ছেলে সন্ত্রাসী মামলায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। অতি ভাল ছেলে। পঁচ ওয়াক্ত মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে। শেষ রাতে ফজরের নামাজ পড়তে বের হয়েছিল, টহল পুলিশ ধরে ফেলেছে। লম্বা চুল দেখে সন্দেহ করেছে। আশেপাশের লোকজনের শত্রুতাও আছে। তারাও তাল দিয়েছে। কিন্তু ছেলে সরকার পার্টি করে। আপনি স্যার এক্ষুণি আই, জি, সাহেবকে টেলিফোন করুন। আপনি না বললে আমাদের অন্য সোর্স ধরতে হবে।
চৌধুরী সাহেব সন্ধ্যা থেকে রাত নটা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে দেন-দরবার শুনেন। সন্ধ্যা থেকে তাঁর মাথাধরা শুরু হয়। রাত নটায় সেই ব্যথা অসহনীয় হয়ে উঠে। তিনি এক সঙ্গে দুটা প্যারাসিটামল এবং একটা সিডাকসিন খেয়ে বাতি নিভিয়ে চুপচাপ চেয়ারে বসে থাকেন। মাথাব্যথা খানিকটা কমলে এশার নামাজ পড়েন। চার রাকাত নামাজ, তাতেই গণ্ডগোল হয়ে যায়। কত রাকাত পড়েছেন তার হিসাব থাকে না। তাঁর ধারণা, প্রতিবারই চার রাকাতের জায়গায় তিনি হয় তিন রাকাত কিংবা পঁচ রাকাত পড়েন। একবার অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন, তিনি রুকুতে দাঁড়িয়ে সুরা ফাতিহা বাদ দিয়ে আত্তাহিয়াতু পড়েছেন। মাখা-খারাপের লক্ষণ ছাড়া আর কি?