সাইদুর রহমান বললেন, চিঠি পড়েছ?
জ্বি।
শায়লার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছে। সেই সব আর তোমাকে বলতে চাচ্ছি না। তোমার কিছু বলার আছে কি না বল।
না।
বেশ আমি তাহলে উঠব।
যাবার আগে এক কাপ চা খেয়ে যাবেন বলেছিলেন। দিতে বলি।
না থাক। চিঠিটা টেবিল থেকে পড়ে গেছে। তুলে রাখ। এই চিঠি অন্যের হাতে
যাওয়া ঠিক না।
তিথি দুপুরে বাবার কাছে এসে দেখে জাফর সাহেব গম্ভীর মুখে বসে আছেন। তিথি বলল, কি হয়েছে বাবা?
জাফর সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। মনে হল মেয়েকে চিনতে পারছেন না।
তিথি বলল, তোমার কি হয়েছে বাবা?
কিছু হয়নি।
আমি ছবি নিয়ে এসেছি।
কিসের ছবি?
পাসপোর্ট সাইজ ছবি।
ও আচ্ছা, আচ্ছা। চল যাই ..।
ট্রেনের টিকিট করেছ?
না, টিকিট করা হয়নি।
কখন করবে?
শরীরটা ভাল লাগছে না। যেতে ইচ্ছে করছে না।
তুমি যাবে না?
জাফর সাহেব ইতস্ততঃ করে বললেন, এক কাজ কর। তুই চলে যা।
আমি একা যাব?
হ্যাঁ। ফাস্ট ক্লাসে যাবি। দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকবি। অসুবিধা কি? গাধাটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যা।
তুমি সত্যি যাবে না?
না।
ঠিক করে বল তো–তোমার কি এর মধ্যে মার সঙ্গে কোন কথা হয়েছে?
না।
আমার দিকে তাকিয়ে বল। অন্যদিকে তাকিয়ে বলছ কেন? কথা হয়েছে মার সঙ্গে?
জাফর সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বললেন, না, কোন কথা হয়নি। চল যাই। দুটার সময় অফিস বন্ধ করে দেয়।
তোমাকে অন্য রকম লাগছে। কি হয়েছে বল তো?
কিছু হয়নি। কিছু হয়নি।
পাসপোর্ট অফিসের কাজ সেরে জাফর সাহেব বললেন, চল, তোর সঙ্গে খানিকক্ষণ ঘুরি। আজ আর অফিসে ফেরত যাব না।
তিথি বিস্মিত হয়ে বলল, আমার সঙ্গে কোথায় যাবে?
তোরা কোথায় কোথায় বেড়াতে যাস তা তো জানি না। তুই আমাকে কোথাও নিয়ে যা। তার আগে চল কোথাও খেতে যাই।
তুমি তো দুপুরে কিছু খাও না।
আজ খাব। খিদে লেগেছে।
চাইনীজ খাবে?
হুঁ।
তুমি সত্যি তাহলে সিলেট যাবে না?
না। তুই যা। গাধাটাকে সাথে করে নিয়ে যা।
তুমি একা একা থাকবে?
হুঁ।
এক দিনেরই তো ব্যাপার। তোরা তো চলেই আসবি।
আমিও থেকে যাই। মাকে টেলিফোন করে আসতে বলি।
টেলিফোন করলে আসবে না। তোকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে। আমাকে যেভাবে সব গুছিয়ে বললি, তোর মাকেও সেইভাবে বলবি। তারপর সঙ্গে করে নিয়ে আসবি। নুরুজ্জামান গাধাটাকে খবর দেয়া দরকার। গাধাটা এখন আছে কোথায়?
দিনে কোথায় থাকে তা তো বাবা জানি না। জিজ্ঞেসও করিনি। রাতে ফিরে আসে। হাতে করে দুটা আনারস ঝুলিয়ে আনে। ভাত খায় না। আনারস খায়।
বলিস কি?
সত্যি বাবা।
তিথি মিট মিট করে হাসছে। তিথির হাসি হাসি মুখের দিকে আনন্দ এবং বিস্ময় নিয়ে জাফর সাহেব তাকিয়ে আছেন। বিস্ময়ের কারণ হল, তার মেয়ে যে এত সুন্দর করে হাসে তা তিনি আগে কখনো লক্ষ্য করেন নি। অন্য মেয়ে দুটি কেমন করে হাসে কে জানে? এরাও কি তিথির মত সুন্দর করে হাসে?
দুপুরবেলা চাইনীজ রেস্টুরেন্টগুলি ফাঁকা থাকে। আজ আরো ফাঁকা। দোতলার হলঘরে একটা লোকও নেই। তিথি বলল, অন্য কোথাও চল তো বাবা। ফাঁকা ঘরে চাহনীজ খেতে ভাল লাগে না।
ফাঁকাই তো ভাল। নিরিবিলি।
হোটেলের নিরিবিলি অসহ্য লাগে। হোটেল থাকবে গমগমা, লোকজনে ভর্তি।
তাহলে চল লোকজনে ভর্তি গমগম হোটেল খুঁজে বের করি।
চল যাই গাড়ি ছেড়ে দাও বাবা। আমরা রিকশা করে ঘুরব।
জাফর সাহেব গাড়ি ছেড়ে দিলেন। রিকশায় উঠেই তিথি বলল, তুমি কি চাইনীজ খাওয়া নিয়ে এই গল্পটা শুনেছ?
কোন গল্প?
ঢাকা শহরে এক লোক হঠাৎ আলাউদ্দিনের চেরাগ হাতে পেয়ে গেল। চেরাগে ঘসা দিতেই দৈত্য এসে উপস্থিত। দৈত্য বলল, জাহাপনা, কি চাই বলুন। হুকুম করুন। হুকুম করলেই হুকুম তামিল হবে।
লোক বলল, প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। কিছু খাবার আন।
দৈত্য বলল, কি খাবার খাবেন হুকুম করুন হুজুরে আলা।
চাইনীজ খাব।
দৈত্য অস্বস্তির সঙ্গে বলল, সত্যি চাইনীজ খাবেন?
অবশ্যই খাব। তোমার অসুবিধা আছে?
জি না। তবে একটু সময় লাগবে।
লাগুক। খাবার যেন ফ্রেশ হয়।
অবশ্যই ফ্রেশ হবে।
লোকটা খাবার জন্যে অপেক্ষা করছে। ঘণ্টা খানেক পর দৈত্য ঘাড়ে করে এক আধ-বুড়ো চাইনীজ নিয়ে উপস্থিত। দৈত্য বলল, হুজুরে আলা, চাইনীজ খেতে চেয়েছেন। চাইনীজ ধরে নিয়ে এসেছি। এক্কেবারে পিকিং থেকে এনেছি বলে বিলম্ব হয়েছে। এখন ব্যাটাকে খান। আমি দেখি।
জাফর সাহেব শব্দ করে হাসলেন। তিথি হাসছে। রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। জাফর সাহেব তাঁর হাসি থামাতে পারছেন না। যতবারই হাসি থামাতে যান ততবারই চোখের সামনে ভেসে উঠে আধবুড়ো চাইনীজটার হতভম্ব মুখ।
তিথি বলল, বাবা থাম তো। অনেক হোসেছ।
জাফর সাহেব হো হো, হা হা করে হাসতেই লাগলেন।
প্লীজ বাবা, থাম। তোমাকে নিয়ে তো ভাল যন্ত্রণায় পড়া গেল। আগে জানলে কে তোমাকে হাসির গল্প বলতো!
মা, আরেকটা গল্প বল তো। হো হো হে। হি হি হি।
তিথি অবাক হয়ে বাবাকে দেখছে। আশ্চর্য, এত হাসি! তিথি তার বাবাকে এমন করে কখনো হাসতে দেখেনি। তাঁর শরীর ভাল তো? অসুস্থ মানুষ মাঝে মাঝে এমন করে, সামান্য কারনে প্রচুর হাসে। প্রচুর কাদে। তিথি প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বলল, বাবা, নুরুজ্জামান সাহেবকে যে নিয়ে যাব–উনি থাকবেন কোথায়? ধর, এক রাত আমাদের সিলেট থাকতে হল। তখন কি করব? উনাকে কি কোন হোটেলে পাঠিয়ে দেব?
জাফর সাহেব হাসি থামাতে পারছেন না। অনেক কষ্টে হাসির ফাঁকে ফাঁকে বললেন, গাধাটাকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিবি–হি হি হি।