সাইদুর রহমানের ভ্রু কুঁচকে গেল। তিনি পাইপে নতুন করে তামাক ভরতে লাগলেন। জাফর সাহেব বললেন, কতক্ষণ হল এসেছেন?
অনেকক্ষণ। আমি এসেছি আটটা চল্লিশে এখন বাজে নটা পঞ্চাশ। তুমি কি সবসময়ই অফিসে এমন দেরী করে আস?
অপমান সূচক প্রশ্ন। এ জাতীয় প্রশ্নের জবাব দেয়াও এক ধরনের অপমান। জাফর সাহেব বললেন, চা দিতে বলব চা খাবেন?
চা খেতে পারি।
বেয়ারাকে চায়ের কথা বলে জাফর সাহেব নিজের চেয়ারে বসলেন। তিনি খানিকটা চিন্তিত। লেফটেন্যান্ট কর্ণেল সাহেব ঠিক কি উদ্দেশ্য এসেছেন বোঝা যাচ্ছে না।
সাইদুর রহমান পাইপে লম্বাটান দিয়ে বললেন, আমি তোমার বাসাতেই। যেতাম। শেষ পর্যন্ত অফিসে আসলাম। কিছু ট্যাকনিক্যাল কথাবার্তা আছে যা
অফিসে বলা যায় না।
কি ট্যাকনিক্যাল কথা?
আমি অনেকদিন থেকেই ভাবছি–তোমার সঙ্গে একটা ফুল ডিসকাশান হওয়া উচিত। তোমার কি বলার আছে আমি শুনতে চাই। এক তরফা কথা শুনলে তো হবে না।
এক তরফা কি কথা শুনেছেন? আমি বুঝতে পারছি না।
চা আসুক। তারপর বলি।
সাইদুর রহমান চোখ বন্ধ করে পাইপ টানছেন। জাফর সাহেবের ইচ্ছা করছে তার বেয়ারাকে ডেকে বলেন, এই হামবাগটাকে ঘাড় ধরে ঘর থেকে বের করে দাও। বের করে দেবার পর যে চেয়ারে হামবাগটা বসেছে সেটা ডেটল পানিতে ধুয়ে দাও। মনে যা ভাবা যায় অধিকাংশ সময়ই তার উল্টোটা করতে হয়। জাফর সাহেব বেয়ারাকে তাড়াতাড়ি চা আনতে বললেন। সাইদুর রহমান বললেন, তোমার ঘরের দরজায় কি লালবাতি জ্বালানোর সিস্টেম আছে? সিস্টেম থাকলে লালবাতী জ্বালিয়ে দাও–আমি চাইনা আমার কথাবার্তায় ইনটারাপসান হোক।
আপনার এমন কি কথা যে লালবাতি জ্বালিয়ে বলতে হবে?
সাইদুর রহমান আবার ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। চা এসে গেছে। তিনি এক চুমুক খেয়ে বললেন, চা তো ভাল বানিয়েছে। যাবার সময় আরেক কাপ খেতে হবে। মনে করিয়ে দিও তো।
মনে করিয়ে দেব। এখন বলুন কি ব্যাপার? লালবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছি ঘরে কেউ ঢুকবে না।
সাইদুর রহমান গম্ভীর গলায় বললেন, শায়লা আমাকে কমপ্লেইন করেছে তুমি নাকি তাকে মারধর কর। ব্যাপারটা কি?
ও আপনাকে বলেছে?
না বললে তো জানতে পারতাম না। আমার কাছে ওহী নাজেল হয় নি। আমি শায়লার কথা শুনে স্তম্ভিত। যার মেয়ে এম. এ. পাশ করেছে তাকে মারধোর করতে সাহস লাগে। তোমার সাহস আছে বোঝা যাচ্ছে।You are a courageous man.
আপনি কি আমাকে শাস্তি দিতে এসেছেন?
না। শাস্তির প্রশ্ন আসে না। তবে শায়লা তোমাকে শাস্তি দিতে চায়। সে ঠিক করেছে তোমার সঙ্গে আর বাস করবে না। এই কথাটাই তোমাকে বলতে এসেছি।
বলুন শুনছি।
ও যা চাচ্ছে তা হল সে তার মেয়েদের নিয়ে থাকবে তুমি আলাদা কোথাও থাকবে। বাড়ি ভাড়া করে থাকতে পার। কিংবা কোন হোটেলে ঘর নিয়ে থাকতে পার। এবং আমার কাছে মনে হয় এটা দুজনের জন্যেই মঙ্গলজনক হবে। সমস্যার ভদ্র সমাধান হবে। কিছুদিন এই ভাবে থাকার পর লোকলজ্জার ভয়েই হোক কিংবা মেয়েদের কারণেই হোক আবার তোমরা একত্রে থাকা শুরু করতে পারবে।
শায়লা এটা চায়?
সে যা চায় তা ভয়াবহ। সে চায় ডিভোর্স। তারতো এম্নিতেই মাথা গরম। উকিল ডেকে এনে হুলুস্থুল কাণ্ড! বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে এটাতে রাজি করিয়েছি।
আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে?
শায়লা তোমাকে একটা চিঠি দিয়েছে। চিঠি আমার সঙ্গেই আছে। চিঠিটা পড়। চিঠিতে সব লেখা আছে। আমি নিজেও পড়েছি। উচিত হয়নি, তবু পড়লাম।
সম্বোধন হীন চিঠি। ইংরেজিতে লেখা। জাফর সাহেবের মনে হল তিনি অপরিচিত কোন মেয়ের লেখা চিঠি পড়ছেন। তার পা কাঁপতে লাগল। শায়লা এসব কি শুরু করেছে। শুরুর লাইনটি হল–
I always longed for Love, never got it…
আমি সবসময় ভালবাসার জন্যে তৃষ্ণিত ছিলাম, কখনো তা পাইনি। তুমি আমার জীবনে রোবট স্বামী হিসেবে এসেছ। আমাদের দুজনের মধ্যে সামান্যতম মিলও ছিল না। আমি বেড়াতে পছন্দ করি, তুমি ঘরে বসে থাকতে পছন্দ কর। আমি গান ভালবাসি–গান শুনলে জীবনটাও রোবটের মত হয়ে গেছে। তুমি আমাকে বদলে দিয়েছ। আমি তোমাকে বদলাতে পারি নি। বরং আমি তোমার মধ্যে ক্রোধ ঘৃণা এইসব নিম্নস্তরের আবেগ তৈরী করেছি যা বেড়ে বেড়ে এখন এই পর্যায়ে এসেছে যে তুমি আমার গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা করছ না। গায়ে হাত তোলার ব্যাপারটি যে এবারই প্রথম ঘটেছে তা না। আগেও ঘটেছে। তোমার মনে নেই। সেই সময় তুমি রাগে অন্ধ হয়ে থাক। এমন রাগের মুহূর্তে মানুষ স্মৃতি শূন্য হয়ে পড়ে। সে কি করে না করে তা সে বলতে পারে না। প্রচণ্ড রাগ তোমার আগে ছিল না। যতই দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে। আমার জন্যেই যে বাড়ছে তাও আমি বুঝতে পারছি। আমিতো নির্বোধ নই। কোনকালে ছিলাম না। বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত তুমি কখনো আমাকে ভালবেসেছ। বলে আমি মনে করি না। তুমি আমাকে সহ্য করে গিয়ে এই পর্যন্ত। এখন তাও পারছ না। পরে কি হবে ভাবতেও আমার ভয় হচ্ছে।
কাজেই আমি মনে করি আর কখনোই আমরা একত্রে বাস করব না এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে হবে। এই সিদ্ধান্ত দুজনের জন্যেই মঙ্গল জনক হবে। যে ফ্ল্যাট বাড়িতে আমরা বাস করছি তুমি নিশ্চয়ই জান সে ফ্ল্যাট বাড়ি আমার টাকার কেনা। আমার বাবা আমাকে যে টাকা দিয়েছেন সেই টাকায়। কাজেই এ বাড়িতে তোমার কোন অধিকার থাকার কথা না। তুমি অন্য কোথাও চলে যাবে। আমাদের টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করার তোমার প্রয়োজন নেই। আমার যা আছে তা দিয়ে আমি আমার মেয়েদের নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারব।