তাঁর ক্ষিধে লেগেছে। এখনো নাশতা করেন নি। মেহমানদের সঙ্গে নিয়ে নাশতা করবেন এই ভেবে রেখেছেন।
তিথি বলল, তুমি খেয়ে নাও বাবা। তারা বোধহয় আসবেন না।
আসবে না কেন?
বাবা আর ছেলের মধ্যে রাগারাগি হয়েছে। মনে হয় বাবার রাগ ভাঙ্গানো যাচ্ছে। তুমি খেয়ে নাও।
ওরা যদি এসে দেখে আমরা নাশতা টাশতা খেয়ে বসে আছি সেটা কি একটা নিতান্তই অনুচিত কাজ হবে না?
আমি না হয় অপেক্ষা করি।
আচ্ছা দে দেখি। নাশতা করেই ফেলি।
জাফর সাহেব লক্ষ্য করলেন তার মেয়ে অনেক খাবারের আয়োজন করেছে। পরোটা, ভূনা গোশত, পাউরুটি, মাখন, ডিম, একটা বাটিতে চিড়া ভাজা, অন্য একটা বাটিতে মুড়ি। জাফর সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, পরোটা তুই ভেজেছিস না-কি? ভাল হয়েছে। খুব ভাল হয়েছে।
তিথি লজ্জিত গলায় বলল, পরোটা আমি ভাজি নি বাবা। পাশের ফ্ল্যাটের অরুনার মা, উনাকে বলেছিলাম। উনি বানিয়ে পাঠিয়েছেন।
গোশতও উনি রান্না করেছেন?
গোশত আমি রান্না করেছি। ভাল হয়নি বাবা?
ভাল হয়েছে। খুব ভাল হয়েছে অনেক পদ করেছিস। ঠিকমত নাশতা করলে দুপুরে আজ আর খেতে হবে না।
তিথির লজ্জা লাগছে। এতগুলি পদ টেবিলে সাজানো বাবা নিশ্চয়ই মনে মনে। হাসছেন। তাছাড়া সে খানিকটা সাজগোজও করেছে। বাবার চোখে পড়ার কথা। তেমন আহামরি কিছু না–চোখে কাজল দিয়েছে। নতুন ভাঁজ ভাঙ্গা একটা শাড়ি পরেছে।
তিথি।
জি বাবা।
তোর কি পাসপোর্ট আছে?
না।
পাসপোর্ট সাইজ ছবি আছে?
না।
তাহলে তুই এক কাজ কর। নিউমার্কেটে গিয়ে পাসপোর্টের জন্যে ছবি তোল। এরা ঘণ্টা খানিকের মধ্যে ছবি দিয়ে দেয়। ঐ ছবি নিয়ে তুই দুপুর বারটার মধ্যে আমার অফিসে চলে আসবি। তারপর তোকে নিয়ে আমি পাসপোর্ট অফিসে যাব। দু দিনের মধ্যে পাসপেটি বের করতে হবে।
তিথি অস্পষ্ট গলায় বলল, কেন?
আমি চাই তোরা দুজন যেন এক সঙ্গে যেতে পারিস। সেটাই ভাল হবে। তোর কোন আপত্তি আছে?
তিথি লজ্জিত গলায় বলল, না।
গুড। আপত্তি থাকাটা কোন কাজের কথা না। আজ সিলেটে যাচ্ছি মনে আছে তো?
মনে আছে।
জিনিস পত্র গুছিয়ে নে। তোর মাকে ধরে বেঁধে নিয়ে আসতে হবে। কাল সকালে পৌঁছব বিকেলের ট্রেনে সবাইকে নিয়ে ঢাকা চলে আসব।
মা আসতে রাজি হবেতো?
অবশ্যই রাজি হবে। মেয়ের বিয়ে মা আসবে না। কি বলিস তুই। ঝগড়া আপাতত মুলতুবী থাক। বিয়ে টিয়ে হয়ে যাক তারপর আবার নতুন উদ্যমে শুরু করা যাবে।
জাফর সাহেব চলে গেছেন। তিথি অপেক্ষা করছে। মারুফের আসার নাম নেই। আসতে না পারলে একটা টেলিফোন তো করবে। তাও করছে না। তিথির খিদে লেগেছে কিন্তু কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না। এতক্ষণ পর্যন্ত না খেয়ে বসে থাকার জন্যেই বোধহয় মাথা ধরেছে। হালকা ধরণের মাথা ব্যথা যা এক সময় সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
তিথি খালি পেটে চা খেল। সকাল থেকে এই পর্যন্ত চার কাপ চা খাওয়া হয়েছে। সে ঠিক করে ফেলল মারুফ না আসা পর্যন্ত সে কিছুই খাবে না। সে যদি আজ রাত এগারোটায় আসে তিথি রাত এগারোটা পর্যন্ত না খেয়ে অপেক্ষা করবে।
মারুফের সবচে বড় সমস্যা হল সে বেশীর ভাগ সময়ই কথা দিয়ে কথা রাখে। তার জন্যে সে মন খারাপ করে না বা দুঃখিতও হয় না। যেন কথা দিয়ে কথা না রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যাপার না। স্বাভাবিক ব্যাপার।
তিথি ঘড়ি দেখে ঠিক এগারোটা বাজার দশমিনিট আগে ঘর তালা দিয়ে বের হল। নিউমার্কেট যেতে লাগবে দশ মিনিট। ছবি তুলে এক ঘণ্টা ঘোরাফেরা করবে। বারোটায় ছবি ডেলিভারী নিয়ে বেবীটেক্সী করে বাবার কাছে চলে যাবে। সেখান থেকে পাসপোর্ট অফিস।
জাফর সাহেব অফিসে এসে দেখেন তার ঘর খোল। ঘরে তিথির বড় মামা বিরক্ত মুখে বসে আছেন। শুধু বসে আছেন বললে ভুল হবে পাইপ টানছেন। পাইপের ধোয়ায় ঘর অন্ধকার। এয়ার কুলার বসানো ঘরে দরজা জানালা বন্ধ থাকে। ধোয়া ঘর থেকে বেরুতে পারে না।
তিথির বড় মামা সাইদুর রহমান আর্মি শটকোর্সে মিলিটারীতে ছিলেন। দশ বছর চাকরির পর লেফটেন্যান্ট কর্ণেল হয়ে রিটায়ার করেছেন। বর্তমানে ব্যবসা করেন। সারাক্ষণই বলেন, ব্যবসার অবস্থা ভয়াবহ। কিন্তু তিনি ভয়াবহ অবস্থায় আছেন বলে মনে হয় না। ধানমন্ডিতে আশি লক্ষ টাকায় দশ কাঠা জমি কিনেছেন। সেখানে পাঁচতলা ফ্ল্যাট বাড়ি হবে। প্রতি তলায় দুটা করে ফ্ল্যাট। একেকটি বিক্রি হবে চল্লিশ লক্ষ টাকায়। এর মধ্যে ৬টি বিক্রি হয়ে গেছে। উত্তরার কাছে উত্তরখান নামের জায়গায় ছ বিঘার মত জমি কিনেছেন। সেখানে বাগানবাড়ি হচ্ছে। বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। সামনে ঝিল, ঝিলে নৌকা। বলতে গেলে হুলুস্থুল ব্যাপার। যে এমন হুলুস্থূল ব্যাপার শুরু করে তার মুখে সারাক্ষণ বিজনেসের অবস্থা ভয়াবহ–এই কথা শুনতে ভাল লাগে না। জাফর সাহেবের অসহ্য লাগে। তিনি রিটায়ার্ড লেফটান্যান্ট কর্ণেল সাইদুর রহমানকে দু চোখে দেখতে পারেন না। মাস খানিক আগে সাইদুর রহমানের ছোটমেয়ে পিঙ্গলার জন্মদিন উপলক্ষ্যে রিভার ক্রুজ হল। জাহাজে করে পাগলা থেকে চাদপুরে যাওয়া এবং ফিরে আসা। রিভার ক্রুজে সবাই গিয়েছে তিনি যাননি। শরীর খারাপের অজুহাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন।
সাইদুর রহমান জাফর সাহেবকে দেখে মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। জাফর সাহেব বললেন, খবর সব ভাল?