জাফর সাহেব আজ সকাল সকাল বাসায় ফিরেছেন। এসে দেখেন তিথি নেই। শূন্য বাড়িতে ঢুকতে ভাল লাগে না। শূন্য বাড়িতে ঢুকলে মনে হয়, বাড়িটা চোখ বড় বড় করে দেখছে। তিনি শুনেছেন, বেশির ভাগ মানুষ পাগল হয় যখন সে একা একা থাকে। একজন কেউ সঙ্গি পাশে থাকলে নাকি কেউ পাগল হতে পারে না।
জাফর সাহেবের গা ছম ছম করতে লাগল। তিনি বাথরুমে ঢুকলেন কিন্তু বাথরুমের দরজা লাগালেন না। তাঁর কেবলি মনে হল–বাথরুমের দরজা লাগালেই আর খুলতে পারবেন না। খুলতে গেলেই দেখা যাবে বাইরে থেকে কেউ দরজা চেপে ধরে আছে।
তিনি রান্নাঘরে গিয়ে গরম পানি বসালেন। এককাপ চা খাওয়া দরকার। টিব্যাগ চা, চিনি এসব নিশ্চয়ই হাতের কাছেই পাওয়া যাবে। তিথি হরদম বানাচ্ছে। রাতে ঘুমুতে যাবার আগেও তার চা খেতে হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার, চা, দুধ, চিনি কিছুই নেই। একটা পাওয়া না গেলে অন্যটা তো পাওয়া যাবে। চা পাওয়া না গেলে দুধ। দুধ পাওয়া না গেলে চিনি। কিছুই নেই।
তাঁর মাথায় রক্ত চড়ে গেল। জিনিসগুলি ঘরেই আছে অথচ তিনি পাচ্ছেন না, তা কেমন করে হয়! এমন তো না যে জিনিসগুলি অদৃশ্য হয়ে আছে বলে তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। ঘরেই কোথাও আছে। যাবে কোথায়? থাকতেই হবে।
সন্ধ্যাবেলা তিথি বাসায় ফিরে দেখে রান্নাঘরের সমস্ত জিনিস মেঝেতে নামানো। ফ্রীজের পানির বোতল নামাতে গিয়ে দুটা পানির বোতল ভেঙেছে। থৈ-থৈ করছে পানি। ভাঙা কাচে জাফর সাহবের পা কেটেছে।
তিথি হতভম্ব হয়ে বলল, কি হয়েছে বাবা?
জাফর সাহেব অপ্রস্তুত গলায় বললেন, চায়ের দুধ, চিনি, চা এইসব কোথায় রেখেছিস? খুঁজে পাচ্ছি না।
গ্যাসের চুলার পেছনেই তো সব রাখা। এই তো।
ও আচ্ছা।
বাবা, তুমি তো দেখি সব একাকার করে ফেলেছ?
হুঁ।
চা খাবে? তুমি বারান্দায় বোস, আমি চা বানিয়ে আনছি।
না, এখন আর ইচ্ছা করছে না। বাদ দে।
তোমার কি শরীর খারাপ করেছে নাকি? দেখি কাছে আসো তো, গায়ে হাত দিয়ে দেখি। না, শরীর তো ঠাণ্ডা।
জাফর সাহেব হাসতে চেষ্টা করলেন। হাসি স্পষ্ট হল না। তিথি বলল, তোমার জন্য স্যাণ্ডউইচ কিনে এনেছি। নাও, স্যাণ্ডউইচ নাও। বাবা, এখন থেকে এই ব্যবস্থা। আমি বাজার থেকে স্যাণ্ডউইচ কিনে ঘরে রেখে দেব। খিদে লাগলে খাবে।
আচ্ছা।
জাফর সাহেব স্যাণ্ডউইচ খেয়ে অবেলায় বিছানায় গিয়ে শুলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন। গাঢ় গভীর ঘুম। তিথি রাত দশটায় অনেক কষ্টে তাঁকে ডেকে তুলল। তিনি জানালেন রাতে কিছু খাবেন না। জ্বর-জ্বর লাগছে।
নুরুজ্জামানও রাতে কিছু খেল না। সে আজও দুটা আনারস কিনে নিয়ে এসেছে। রাতে ভাতের বদলে আনারস খেয়েছে। তিথি ভেবে পাচ্ছে না লোকটা পাগল কি-না।
নুরুজ্জামানের আজ অবশ্যি আনারস কেনার কোন ইচ্ছা ছিল না। সে গিয়েছিল আনারসওয়ালাকে ধন্যবাদ দিতে। ঐদিনের আনারস অসম্ভব মিষ্টি ছিল, খেয়ে তৃপ্তি পেয়েছি–এই কথাগুলি শুধু বলে আসা, লাভের মধ্যে লাভ এই হয়েছে। আনারসওয়ালা আরো দুটা ধরিয়ে দিয়েছে।
টেকা না থাকলে পরে আইস্যা দাম দিয়েন। অসুবিধা কিছু নাই। আর দাম না দিলেও ক্ষতি নাই। দুইটা আনারসের জন্য আমি না খাইয়া মরুম না।
এই কথার পর না কিনে উপায় থাকে না।
তিথি একা একা খেতে বসল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নুরুজ্জামান এসে সামনে বসল। অপরিচিত একজন পুরুষ মানুষের সামনে বসে খাওয়া অস্বস্তিকর। তাকে উঠে চলে যেতে বলা আরো অস্বস্তিকর।
নুরুজ্জামান বলল, স্যার খাবেন না?
না, বাবার শরীরটা ভাল না।
কি হয়েছে?
তেমন কিছু না। গা গরম। আপনি রাতে যদি কিছু না খান তাহলে শুধু জেগে আছেন কেন? শুয়ে পড়ুন।
আপনি একা একা খাবেন এই জন্যে বসে আছি।
আমার জন্যে বসে থাকতে হবে না। আমার একা খেতেই ভাল লাগে।
স্পষ্ট ইংগীত। এরচে স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় আপনি দয়া করে উঠে যান। তো। আমার সামনে ড্যাব ড্যাব চোখে বসে থাকবেন না। নুরুজ্জামান বসেই আছে। লবনদানী থেকে খানিকটা লবন হাতে নিয়ে আংগুলে করে খাচ্ছে। লবন কি একটা খাবার জিনিস?
নুরুজ্জামান বলল, রাতে ভাত না খাওয়াটা ঠিক না। এতে শরীর থেকে একটা চড়ুই পাখির রক্ত চলে যায়।
তাই না-কি?
গ্রামের কথা। মা চাচীর মুখে শুনেছি।
আপনি যা শুনেন তাই বিশ্বাস করেন?
জ্বি। বিশ্বাস করাই ভাল। শুধু শুধু অবিশ্বাস করব কেন?
আমি যদি বলি, কাল রাতে একটা ভূত এসে আমার খাটের নিচে শুয়েছিল তাহলে বিশ্বাস করবেন?
আপনি বললে অবশ্যই করব। আপনি শুধু শুধু আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবেন কেন?
কথার পিঠে কথা বলে যেতে তিথির ভাল লাগছে না। তাছাড়া তাকে অর্জি অনেক কথা বাবাকে গুছিয়ে বলতে হবে। মারুফের সঙ্গে তার সম্পর্ক, মারুফের বাইরে যাবার ব্যাপার। অল্প কদিনের জন্যে যে বিয়ের পর্ব শেষ করতে হবে সেটা। তাছাড়া মার সঙ্গেও কথা বলতে হবে। ছোট মামার টেলিফোন নাম্বার আছে। এরিয়া কোড জানা নেই। কোথাও নিশ্চয়ই লেখা আছে।
নুরুজ্জামান হাসি মুখে বলল, পাতা জোগার হয়েছে।
কি জোগার হয়েছে?
পাতা। অশ্বথের পাতা।
অশ্বথের পাতা দিয়ে কি করবেন?
পাতার বাঁশি বাজাব।
ও আচ্ছা আচ্ছা। ভুলে গিয়েছিলাম।
আপনি শুনতে চাইলে খাওয়ার পর খানিকক্ষণ…
আরেকদিন শুনব। আজ আমার বাঁশি শুনতে ইচ্ছা করছে না।
জ্বি আচ্ছা।
আপনি শুয়ে পড়ুন।
আপনার খাওয়া শেষ হলেই শুয়ে পড়ব।