এই মিথ্যায় কারো কোন ক্ষতি হবে না। বরং সবারই লাভ হবে। যে বিয়ে অনেকদিন ধরে ঝুলছে সেই বিয়েটা হয়ে যাবে। তিথি অসুখী হবে না কারণ সে মানুষ হিসেবে প্রথম শ্রেণীর না হলেও উপরের দিকে–দ্বিতীয় শ্রেণী। চারপাশে তৃতীয় শ্রেণীর মানুষের ভীড়ে উপরের দিকে। দ্বিতীয় শ্রেণী–খারাপ কি? কৌশল ছাড়া বিয়ে সম্ভবও হবে না। যার পেশা প্রাইভেট টিউশ্যানী তাকে কে মেয়ে দেবে?
তিথি ঠিক তার জায়গায় বসে আছে। পিজা কিং-এর এক কোণায়। হাতে পানির গ্লাস। মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। মারুফের ধারণা, মেয়েরা ঘরে কখনো খবরের কাগজ পড়ে না। তারা কাগজ পড়ে ঘরের বাইরে অদ্ভুত অদ্ভুত সব জায়গায়। এবং পড়ার সময় জগৎ-সংসার ভুলে যায়। তিথি একবারও তাকাচ্ছে না। পেছন থেকে চুক করে মাথায় টোকা দিলে হয়। তিথি অবশ্যি মাথায় টোকা দিলে রেগে যায়। এই সকাল বেলাতেই রাগিয়ে দিলে মুশকিল হবে। মেয়েরা চট করে রাগ ধুয়ে ফেলতে পারে না। তারা অনেকক্ষণ রাগ পুষে। পাখি পোষার মত রাগ পুষেও তারা আনন্দ পায়।
মারুফ সামনের চেয়ারটায় বসল। তিথি খবরের কাগজ থেকে চোখ না তুলেই বলল, দাড়ি রাখছ নাকি?
মেয়েদের বোধহয় দৃশ্যমান চোখ ছাড়াও কয়েক জোড়া অদৃশ্য চোখ আছে। না তাকিয়েই কি করে দেখল? মারুফ বলল, ।
দাড়িতে তোমাকে ভাল দেখাচ্ছে। নূর সাহেবের মত লাগছে।
নূর সাহেবটা কে?
আসাদুজ্জামান নূর–অভিনয় করে।
ও আচ্ছা।
তিথি খবরের কাগজ ভাঁজ করতে করতে বলল, তোমার জরুরী কথাটা কি চট করে বলে ফেল। আমাকে উঠতে হবে।
মারুফের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে শুকনো গলায় বলল, উঠতে হলে ঊঠ। জরুরী কথা আরেকদিন বলা যাবে।
রেগে গেলে না-কি?
না, রাগিনি।
মুখ গম্ভীর করে রেখেছ কেন?
আমার মুখটাই গম্ভীর টাইপের। খুব হাসিখুশি অবস্থাতেও আমাকে দেখলে মনে হবে কয়েকরাত ঘুম হচ্ছে না। ডিসপেপসিয়ায় ভুগছি এবং আমার পিঠে কার্বাঙ্কল হয়েছে।
পিঠে কি হয়েছে?
কার্বাঙ্কল।
সেটা কি?
মারুফ কফি দিতে বলল। পিজা কিং—ওর ছেলেটাকে পাঠালো এক প্যাকেট সিগারেট আনতে। তিথি হাসিমুখে বলল, তোমার জরুরী কথাটা কি আমাকে বলে ফেল তো।
থাক।
থাকবে কেন? বল।
মারুফ হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।
এইটাই তোমার জরুরী কথা?
হুঁ।
বাইরে কোথায়? চাঁদপুর না কুমিল্লা?
কফির কাপ দিয়ে গেছে। সিগারেট আনেনি। আগে সিগারেট না ধরিয়ে চা বা কফির কাপে চুমুক দিতে কুৎসিত লাগে। হঠাৎ মুখ মিষ্টি হয়ে যায়। মারুফ বিমর্ষ ভঙ্গিতে কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, ব্রিসভেন যাচ্ছি।
সেটা কোথায়?
ফ্রান্সের একটা ছোট শহর।
বল কি! কবে?
আঠারো তারিখ। শেষ রাতের ফ্লাইট। তিনটা কি সাড়ে তিনটায়।
কোন মাসের আঠারো তারিখ? এই মাসের?
হ্যাঁ।
কি সর্বনাশ! আর তে মোটে দশ দিন আছে।
দশদিন না, ন দিন। আজকের দিনটা বাদ দাও।
তিথির নিজেকে সামলাতে সময় লাগছে। সে খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল, তুমি তো সারাজীবন চেয়েছ আমেরিকা যেতে, এখন আমেরিকা বাদ দিয়ে ফ্রান্স?
কি করব–আমেরিকা যাবার সুযোগ পেলাম না—। হাতে যা পেয়েছি তাই সই। কানা মামা যখন পাওয়া যাচ্ছে না তখন অন্ধমামা।
কতদিনের জন্যে যাচ্ছ?
পিএইচ.ডি. করতে যতদিন লাগে–ধরে নাও চার বছর।
মারুফের সিগারেট চলে এসেছে। সে সিগারেট ধরিয়েছে। এতগুলি মিথ্যা কথা এক নাগাড়ে বলায় কেমন ক্লান্ত লাগছে। দ্রুত কয়েকটা সিগারেট টেনে শক্তি সঞ্চয় করতে হবে।
তিথি খুশি খুশি এবং আনন্দিত চোখে তাকিয়ে আছে। এরকম চোখের মেয়ের কাছে মিথ্যা বলাও কষ্টের ব্যাপার। মিথ্যাটা কাঁটার মত বুকে বিঁধে থাকে। তিথি বলল, এ তো খুব আনন্দের ব্যাপার। তুমি এমন মুখ কালো করে আছ কেন?
অনেক ঝামেলা বাকি আছে। ভিসা হয়নি। পাসপোর্ট রিনিউ করতে হবে। এর মধ্যে দেশে গিয়ে মাকে দেখে আসতে হবে।
দেশে যাবে কবে?
আজ রাতের ট্রেনে চলে যাব। একদিন থেকে পরশু আসব। কপড়-চোপড়ও বানাতে হবে। ভাল কাপড় তো কিছুই নেই।
আমি দেখে-শুনে তোমার জন্যে কাপড় কিনে দেব। চল আজই চল।
তোমার না-কি কাজ আছে বলছিলে? এমন কোন কাজ নেই।
কাঁচা বাজার করব ভেবেছিলাম। পরে যাব। চল, গুলশান মার্কেট যাই। ওখানে সুন্দর সুন্দর শার্ট পাওয়া যায়।
আজ থাক। টাকা আনিনি।
চল পছন্দ করে আসি, পরে কিনবে।
চল।
মারুফ কফির বিল দিল। দশটাকার একটা ময়লা নোট দোকানের ম্যানেজারের কাছ থেকে বদলে নিয়ে যে সিগারেট এনে দিয়েছে তাকে বখশীশ দিল।
তিথি বলল, তুমি একটু হাল তো তোমাকে দেখে খুব খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে তোমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছে।
আকাশ ভেঙে পড়ার মতই। তিথি, রিকশা নেবার আগে চল খানিকক্ষণ হাঁটি। তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে। কথাগুলিই জরুরী। এতক্ষণ যা বললাম তা জরুরী না।
ঢাকার রাস্তাগুলি এখন আর হেঁটে বেড়ানোর জন্যে নয়–গাদাগাদি ভিড়। পাশাপাশি গল্প করতে করতে দুজন যাবে, তা হবে না। যেতে হবে একজনের পেছনে একজন এবং সারাক্ষণই টেনশান থাকবে এই বুঝি সামনের লোকটা হারিয়ে গেল।
যন্ত্রণার উপর যন্ত্রণা। তিথির পেছনে তখন থেকে এক ফুলওয়ালী হাঁটছে। আফা, মালা নেন না, আফা, মালা নেন না। ফুলের মালার মত একটি উঁচু শ্রেণীর পণ্যদ্রব্য বিক্রি করলেও এদের আবার আচরণ নিম্ন শ্রেণীর। এরা জোকের মত লেগে থাকে। না কিনে উপায় নেই।
তিথি মারুফকে বলল, এই, ফুলওয়ালীর হাত থেকে আমাকে বাঁচাও তো। অসহ্য লাগছে। শাড়ি ধরে টানছে, গায়ে হাত দিচ্ছে।