তিথি!
জি বাবা।
তোর মা বোধহয় আজ রাতে সিলেট যাচ্ছে বেড়াতে। তুইও যা, ঘুরে আয়। আমার এখানে অসুবিধা হবে না। হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে খেয়ে নেব।
আমার এখানে জরুরী কাজ আছে। আমি যেতে পারব না। আমি যাই কি না যাই সেটা বড় কথা না। বড় কথা হল, তোমাদের ঝগড়াটা মিটমাট হওয়া দরকার।
আমার অসহ্য লাগছে।
জাফর সাহেব কিছু বললেন না, তিথি চেয়ার টেনে বাবার সামনে বসল। মনে হচ্ছে সে ঝগড়া করবে।
বাবা!
হুঁ।
তুমি ভয়ংকর একটা অন্যায় করেছ। তুমি মার গায়ে হাত তুলেছ। আমি তো কল্পনাও করতে পারিনি যে, তুমি এমন একটা কাজ করতে পার। তুমি মাকে চড় দাও নি?
হুঁ।
কি করে এরকম একটা কাজ করলে?
জাফর সাহেব বিড় বিড় করে বললেন, রেগে গিয়েছিলাম। রেগে গেলে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। মানুষ পশুর মত আচরণ করে।
এত রেগেই-বা কেন গেলে?
সে আমাকে গালাগালি করতে করতে তোর দাদাকে গালি দেয়া শুরু করল। বলল–তুমি যেমন গাধা, তোমার বাবাও গাধা। চট করে মাথায় রক্ত উঠে গেল।
দাদাকে গাধা বলতেই তো আর উনি গাধা হয়ে যাননি।
তা যায়নি। তবু বাবাকে গালাগালিটা সহ্য হল না। আমাকে যদি কেউ গাধা বলে–তোর কি ভাল লাগবে?
না, ভাল লাগবে না। কিন্তু আমি তার জন্যে মারামারি শুরু করব না।
একেক জন মানুষ একেক রকমের মা। কারো রাগ বেশি, কারোর কম।
চা খাওয়া হয়েছে?
হুঁ।
এখন ডিমটা খাও।
ডিম খাব না।
খাও বলছি। আমি কষ্ট করে ভাজলাম আর তুমি খাবে না। এই দেখ, ডিম ভাজতে গিয়ে আমার হাত পুড়ে গেছে। গরম তেল ছিটকে এসে পড়ল।
জাফর সাহেব ডিমের প্লেট হাতে নিলেন।
নুরুজ্জামান তার ঘরে গামলা ভর্তি আনারস নিয়ে বসে আছে। দোকানদার মিথ্যা বলেনি। মধুর মতই মিষ্টি। দুপুরে খাওয়া না হওয়ায় তার খিদে লেগেছে প্রচও। সে দ্রুতগতিতে আনারস খেয়ে চলেছে। নুরুজ্জামানের মনে হল এমন মিষ্টি আনারস সে এই জীবনে খায়নি। মনে হয় বাকি জীবনেও খাবে না।
দরজায় টোকা পড়ছে। নুরুজ্জামান বলল, কে?
তিথি বলল, আমি। আসব?
জ্বি আসুন।
তিথি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, গামলা ভর্তি আনারস নিয়ে বসেছেন বলে মনে হচ্ছে।
নুরুজ্জামান লজ্জিতমুখে বলল, আনারসটা খুব মিষ্টি।
এক সঙ্গে এতটা খেতে পারবেন?
পারব। দুপুরে খাইনি তো। খুব খিদে লেগেছে।
দুপুরে খাননি কেন?
ঘোরাঘুরি করতে করতে সময় পার হয়ে গেল।
ভাত রান্না করা আছে। গরম করে দেব?
জি না।
আপনাকে একটা কাজ করে দিতে হবে।
অবশ্যই দেব।
একটা ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। সেখানে আমার মা আছেন। মাকে কিছু জিনিস পৌঁছে দিতে হবে। পারবেন না?
এক্ষুণি দিয়ে আসছি।
এক্ষুণি দিতে হবে না। আপনি আপনার আনারস শেষ করুন।
জি আচ্ছা।
চা খাবেন? চা করে দেব?
জি-না। ফল খাবার পর পানি জাতীয় কিছু খেতে নেই। খণার বচন আছে–
ফল খেয়ে পানি খায়
যম বলে আয় আয়।
যম আয় আয় বললে পানি না খাওয়াই ভাল।
তিথি ভাত বসিয়েছে। চেয়ার এনে বসে আছে চুলার পাশে। ভাত রান্নার জন্যে ঘরে একটা রাইস কুকার আছে। তিথি সেই কুকারের ব্যবহার জানে না। জানলে এত সমস্যা হত না। তার কাছে মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে সবচে জটিল কাজ হচ্ছে ভাত রান্না। ভাত কখন নরম হবে কখন শক্ত হবে কিছুই বলা যায় না। এবার মা এলে তার কাছ থেকে খুব ভাল করে কয়েকটা জিনিস শিখে নিতে হবে। ভাত রান্না এবং তরকারির রং সুন্দর করার কৌশল। তরকারি যা রান্না হচ্ছে খেতে খারাপ হচ্ছে না, কিন্তু দেখাচ্ছে কুৎসিত। মাটি-মাটি ধরনের হলুদ রঙ। টাইফয়েড রোগির পথ্য।
জাফর সাহেব রান্নাঘরে উঁকি দিলেন। মেয়েকে রান্নাঘরের চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে খুব অবাক হলেন। বিস্মিত হয়ে বললেন, হয়েছে কি তোর? এরকম চুপচাপ বসে আছিস কেন?
ভাত রাঁধছি।
ভাত রাধলে চুলার পাশে এরকম গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে হয়?
অন্যের হয় না, আমার হয়। ভাত রান্নার সময় যে কটা সূরা আমার জানা আছে সব কটা আমি পড়ে ফেলি।
সূরা পড়ে ভাত রাঁধতে হবে না। চুলা বন্ধ কর।
রাতে আমরা খাব না?
চল যাই কোন একটা চাইনীজ হোটেল থেকে খেয়ে আসি।
আর নুরুজ্জামান সাহেব? উনি?
ওর জন্যে খাবার নিয়ে আসব।
রোজ রোজ তো আর চাইনীজ খাওয়া যাবে না।
একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই। তুই উঠে আয়। কাপড় পর।
তিথি উঠে এল। জাফর সাহেব বললেন, ভাল করে সাজগোজ করতো। তিথি বিস্মিত হয়ে বলল, কেন?
এম্নি। সাজলে তোকে কেমন দেখায় দেখি। দোকান যদি খোলা থাকে তোকে সুন্দর দেখে একটা শাড়ি কিনে দেব।
তিথি বলল, দরকার নেই। তুমি কিনে দেবে, মার রঙ পছন্দ হবে না। সে আবার দোকানে বদলাতে নিয়ে যাবে। এটা শুনে তুমি আবার রাগ করবে। আমার শাড়ি কেনার দরকার নেই। বাইরে খেতে যাচ্ছি, চল খেয়ে আসি।
তিথি সাজগোজ করবে না বললেও ভালই সাজল। ঢাকা শহরে রাতে গয়না পরে বের হওয়া একেবারে নিষিদ্ধ। তবু সে গলায় একটা হার পরল। কপালে খুব যত্ন করে টিপ আঁকল। গত জন্মদিনে কেন নীল জামদানী শাড়িটা পড়ল। শাড়িটা তার পছন্দ না। এই প্রথম পরছে। বড় বড় শাদা ফুল। চোখে লাগে, কিন্তু পরবার পর সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে রইল। এতো সুন্দর লাগছে তাকে। আশ্চর্য তো!
জাফর সাহেব বললেন, তোর ফোন এসেছে। ফোনটা ধর। মাই গড! তুই সাজবিনা বলেও দেখি মারাত্মক সাজ দিয়েছিস।
সুন্দর লাগছে বাবা?
খুব সুন্দর লাগছে। ক্যামেরায় ফিল্ম আছে কি না দেখ তে। ফিল্ম থাকলে তোর একটা ছবি তুলে রাখব।