দুপুরে তিথি খানিকক্ষণ ঘুমুলো। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল, টেলিফোন ঠিক হয়ে গেছে। মারুফ কথা বলছে। মারুফ বলছে–শোন তিথি, পশুর সঙ্গে মানুষের সবচে বড় তফাৎ হল–মানুষ দলবল নিয়ে খেতে পছন্দ করে। পশু তার খাবার নিয়ে একা একা চলে যায়। এমনভাবে খায় যেন কেউ দেখতে না পারে।
তিথি বলল, পাখিদের বেলায় কি হয়?
পাখিদের জন্যেও একই ব্যাপার। শুধু খাচায় বন্দি পাখিদের একসঙ্গে খেতে হয় কারণ তাদের উপায় নেই। ক্রিং ক্রিং ক্রিং।
তিথি বলল, ক্রিং ক্রিং শব্দ হচ্ছে কেন?
মারুফ বলল, বুঝতে পারছি না। বোধহয় তোমাদের বাসায় কলিংবেল বাজছে।
দরজা খুলে দেব?
দরজা খোলার কোন দরকার নেই। তুমি ঘুমুতে থাক। যে এসেছে সে খানিকক্ষণ বেল বাজিয়ে চলে যাবে।
ক্রিং ক্রিং ক্রিং।
তিথির ঘুম ভাঙল। কলিং বেল না, টেলিফোন বাজছে। ঘুমের ঘোর তার এখনো কাটেনি। সে জড়ানো গলায় বলল, হ্যালো।
ওপাশ থেকে শায়লা বললেন, তোদের টেলিফোন নষ্ট না কি? সকাল থেকে টেলিফোন করছি, লাইন পাচ্ছি না।
টেলিফোন নষ্ট ছিল না। এখন ঠিক হয়েছে। তুমি কেমন আছ?
ভাল। শোন, আমরা সিলেট যাচ্ছি।
কবে?
আজ রাতের ট্রেনে, সুরমা মেল। তোর ছোট মামার চা বাগান দেখে আসি। তুই যাবি?
অবশ্যই যাব।
তাহলে তোর কাপড়-চোপড় গুছিয়ে এখানে চলে আয়। আমি এক ঘণ্টা পরে গাড়ি পাঠিয়ে দেব। আমার ঘরে পরার কয়েকটা শাড়ি সঙ্গে নিয়ে আসবি–আর কাবার্ডের নিচে রাখা স্যাণ্ডেল জোড়া আনবি।
ইটালীয়ান স্যাণ্ডেল?
হ্যাঁ।
ক দিন থাকবে?
ঠিক নেই। চার-পাঁচ দিন থাকতে পারি।
বাবাকে তাহলে এক সপ্তাহের ছুটি নিতে বলি?
ওর ছুটি নেয়া-নেয়ির কি আছে?
বাবা কি সঙ্গে যাচ্ছে না?
না।
সে-কি।
তুই মনে হয় আকাশ থেকে পড়লি।
বাবা একা একা থাকবে?
হ্যাঁ থাকবে। সে কচি খোকা না। তাকে ফিডিং বোতল দিয়ে দুধ খাওয়াতে হয় না।
বাবা একা থাকবে আর আমরা দল বেঁধে বেড়াতে যাব?
হ্যাঁ।
তাহলে মা তোমরা যাও, আমি যাব না।
তুই যাবি না?
না। এবং মা আমার মনে হয়–তুমি বাড়াবাড়ি করছ।
আমি বাড়াবাড়ি করছি না। তুই বাড়াবাড়ি করছিস। আমি তোর বাবাকে একটা কঠিন শিক্ষা দিতে চাচ্ছি–তোর জন্যে পারছি না।
কঠিণ শিক্ষা শুধু বাবার একার হবে কেন? তোমারও তো হওয়া উচিত।
তুই কি বললি?
রাগ করো না, মা।
যার যা ইচ্ছা আমাকে বলে যাবে আর আমি রাগ করব না?
মা শোন, চল আমরা সিলেট থেকে ঘুরে আসি। অনেক দিন ফ্ল্যাট বাড়িতে থেকে থেকে আমাদের মন-টন ছোট হয়ে গেছে। বাইরে ঘুরলে ভাল লাগবে। বাবাও আমাদের সঙ্গে যাক। তুমি তাঁর সঙ্গে কথা বলো না–তাহলেই হল। তুমি এমন ভাব করবে যেন বাবা একজন অপরিচিত মানুষ। আমার সঙ্গে চাল চালবি না তিথি।
আমি কোন চাল চালছি না মা।
আমি তোর বাবাকে এমন শিক্ষা দেব যে সে তার নিজের নাম পর্যন্ত ভুলে যাবে। তার এত বড় সাহস, সে আমার গায়ে হাত তুলে …।
সে কি
এখন দেখি একবারে আঁৎকে উঠলি। তোর বাবা এলে তাকে জিজ্ঞেস করিস, তারপর তুই তোর বাবার হয়ে ওকালতি করিস। তার আগে না।
তিথি চুপ করে রইল, টেলিফোনের ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তির্থি কি করবে বুঝতে পারছে না। তিথি নরম করে ডাকল, মা।
কি?
ফ্রীজের ঠাণ্ডা ভাত কি করে গরম করতে হয়?
জানি না। চুপ কর।
শায়লা টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন।
পাঁচটা বেজে গেছে। জাফর সাহেবের আসার সময় হয়ে গেল। বিকেলে নাশতা দেয়ার মত কিছু নেই। ময়দা আছে, লুচি ভেজে দেয়া যায়। ঘরে ডিম আছে। ডিমের ওমলেট আর লুচি ভাজা।
তিথি অনেক খুঁজেও লুচি বেলার বেলুন পেল না। একটা টিন ভর্তি চিড়া আছে। তার মুখ খুলে দেখা গেল কাল কাল পোকা পড়ে গেছে। তিথির অস্থির লাগছে। বাবা ক্ষুধার্ত হয়ে অফিস থেকে ফেরেন। হাত-মুখ ধুয়েই কিছু খাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁকে দেয়ার মত কিছুই নেই।
তিথি চায়ের পানি চড়াল।
জাফর সাহেব এলেন সাড়ে পাঁচটার দিকে। নুরুজ্জামান তাঁর সঙ্গেই এসেছে। সে ঠিক পাঁচটায় অফিসে গিয়ে উপস্থিত। নুরুজ্জামান আরো দুটা আনারস কিনেছে। দোকানদার বলে দিয়েছে–মধুর মত মিষ্টি না হইলে আমার দুই গালে দুই চড় দিবেন।
এদের কথা বিশ্বাস করা ঠিক না তবু সে দুটা কিনে ফেলেছে।
তিথি বলল, আমি আনারস খাই না। বাবাও খান না। আপনি শুধু শুধু এনেছেন।
নুরুজ্জামান বিব্রতমুখে বলল, আনারস একটা ভাল ফল।
তিথি বলল, মোটেই ভাল ফল না। এর সারা গা ভর্তি চোখ। আনারসের দিকে তাকালে মনে হয় সেও হাজার হাজার চোখ মেলে আমাকে দেখছে। এই আনারস আপনাকেই খেতে হবে।
জি আচ্ছা।
আনারস কি করে কাটতে হয় তাও জানি না। আপনাকেই কাটতে হবে।
একটা বটি দিন।
রান্নাঘরে চলে যান। খুঁজে বের করুন। এই বাড়ির কোথায় কি আছে আমি জানি না।
নুরুজ্জামান বটির খোজে রান্নাঘরে চলে গেল। তিথি চা নিয়ে গেল বাবার কাছে।
অফিস থেকে ফিরে জাফর সাহেব সাধারণত হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় বসে থাকেন। মাগরেবের আজানের পর উঠেন। তার আগে না। সারাদিন এই এক ওয়াক্তের নামাজই তিনি পড়েন। আজ তিনি শোবার ঘরে হাত-পা এলিয়ে শুয়ে আছেন। তিথিকে দেখেই বললেন, চা খাব না রে মা।
চা খাবে না কেন? শরীর খারাপ?
জ্বর জ্বর লাগছে।
ক্লান্ত হয়ে আছ এই জন্যে জ্বর জ্বর লাগছে। ডিমটা খাও। বেশি করে কঁচা মরিচ দিয়ে ওমলেট করে এনেছি। ওমলেট খেয়ে চা খাও, দেখবে ভাল লাগবে।
জাফর সাহেব উঠে বসলেন। ডিম নিলেন না। চায়ের কাপটা নিলেন।