সে কথা বলেই যাচ্ছে। বলেই যাচ্ছে। তাকে এখন আর থামানো যাবে না। একটা সূঁচ-সূতা এনে তার ঠোঁট সেলাই করে ফেললেও সে কোন না কোনভাবে কথা বলবে। আমি মাথার উপর লেপ টেনে দিলাম। অন্যকিছু ভাবতে চেষ্টা করছি। মিষ্টি কোন স্মৃতি –যা আমাকে বর্তমান ভুলিয়ে দেবে। এমন কিছু কি আছে? টুকুনের কথা ভাবব? না না, টুকুন না, টুকুনের কথা ভাবব না। কিছুতেই না। তবে মনে মনে তার কাছে একটা চিঠি লেখা যায়। মনে মনে লেখা চিঠি নাকি পৌঁছে যায়। এই পৃথিবী খুব রহস্যময়। পৃথিবীর অনেক রহস্যের একটা রহস্য হচ্ছে– মনের চিঠি। ঠিকানা লাগে না, পোস্টাল কোড লাগে না। চিঠি লিখলেই হল —
আমার ছোট্ট বাবা টুকুন সোনা,
তুমি এখন কি করছ গো সোনা? ভাল আছ? ঘুমুচ্ছ? আজ বেশ শীত পড়েছে, তাই না বাবা? গায়ে লেপ আছে তো? তোমার বিশ্রী অভ্যাস আছে গা থেকে লেপ ফেলে দেয়ার। ঠাণ্ডা লেগে গেলে খুব কষ্ট হবে। কাজেই সাবধান। খালি পায়ে মেঝেতে হাঁটাহাঁটি করবে না। এবং কখনো মন খারাপ করবে না। যদি কোন কারণে মন খারাপ হয়, সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে বলবে। ছাদের রেলিং ধরে কখনো নিচে উঁকি দেবে না। আর একা একা ছাদে যাবারও দরকার নেই।
বাবা, তুমি কি এখন গল্পের বই পড়তে পার? আমি সুন্দর সুন্দর কিছু গল্পের বই কিনে তোমাকে পাঠাব। আর একটা সুন্দর খাতা এবং কলম কিনে পাঠাব। ঐ খাতাটায় তুমি রোজ মাকে চিঠি লিখবে। আমি একদিন গিয়ে তোমার সেই খাতা নিয়ে আসব।
শোন বাবা, এবার কি তোমার জন্মদিন খুব ধুমধাম করে হয়েছে? জন্মদিনে কি কি উপহার পেয়েছ? একদিন এসে সব দেখে যাব। আমি তোমার জন্যে জন্মদিনের একটা উপহার কিনে রেখেছিলাম। দিতে পারিনি। সমস্যা কি হয়েছে জান বাবা –আমি ইচ্ছা করলেই তোমাদের বাড়িতে আসতে পারি না। তোমার বাবার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছে। বড়রাও মাঝে মাঝে ঝগড়া করে। কাজেই দুজন দুজায়গায় থাকছি। কিন্তু আমরা দুজনই তোমাকে অনেক অনেক ভালবাসি। এখন তুমি তা বুঝতে না পারলেও … যতই দিন যাবে ততই বুঝতে পারবে …
না, চিঠিটা ভাল হচ্ছে না। আমি মনে মনে লেখা চিঠির পাতাটা ছিঁড়ে ফেললাম। টুকুনের চিঠিতে বড়দের ঝগড়ার কথা কিছু থাকার প্রয়োজন নেই। ওর চিঠি থাকবে ভালবাসায় ডুবানো।
বারান্দায় বাবলুর কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে না। ও কি চলে গেছে? কখন গেল? পানির পিপাসা হচ্ছে। উঠতে ইচ্ছা করছে না। চোখে ঘুম নেমে আসছে। ঘুমের মধ্যেই ঠিক করলাম, কাল সকালে মামুনের সঙ্গে দেখা করব –তাকে বলব … কি বলব তাকে? …
.
০৩.
প্লেট ভর্তি ভাপা পিঠা নিয়ে ভোরবেলাতেই পান্না ভাবী উপস্থিত। তিনি হাসিমুখে বললেন, রাত্রি নাও তোমার জন্যে গরম পিঠা এনেছি। এক্ষুণী খাও –ঠাণ্ডা হলে খেতে পারবে না।
পান্না ভাবী ভোরবেলাতেই গোসল করেছেন। চুল ভেজা। পাট ভাঙ্গা নতুন শাড়ি পরেছেন। তাকে সুন্দর লাগছে। কাল রাতে বাবলুর কুৎসিত কথা তিনি নিশ্চয়ই শুনেননি। শুনলে এত হাসিখুশি তাঁকে দেখাতো না। আমি বললাম, ভাবী আপনাকে সুন্দর লাগছে। সকালবেলা এত সাজ গোজ?
আজ তোমার ভাইয়ের জন্মদিন। ভাবলাম সাজগোজ করে –পিঠা বানিয়ে জন্মদিনের মানুষটাকে চমকে দেই। ভাপা পিঠা তোমার ভাইয়ের খুব পছন্দ।
নাজমুল ভাইকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে দেবেন ভাবী।
আমি জানাব কেন? তুমি জানিও। তুমি জানালেই বেশি খুশি হবে। পিঠা খাও– ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
আমি পিঠা মুখে দিলাম। আগুন গরম-ভাপ উঠছে।
কেমন হয়েছে?
খুব ভাল।
পিঠার মধ্যে ভাপা পিঠা বানানোই সবচে কঠিণ যদিও দেখে মনে হয় সবচে সহজ। একটু উনিশ বিশ হয়েছে কি পিঠা শক্ত হয়ে যাবে। খেয়ে স্বাদ পাবে না।
মোটেও শক্ত হয় নি। খেতে খুব ভাল হয়েছে।
ছ পিস এনেছি। তোমাদের সবার জন্যে দু পিস করে।
পান্না ভাবী থংকস।
যার জন্যে সাতসকালে পিঠা বানালাম সে এখনো ঘুমে। মনে হয় কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগেছে। তার ঘুম ভাঙ্গার আগেই কিছু ফুল এনে বিছানায় ছড়িয়ে দেব। আইডিয়া কেমন?
খুব ভাল আইডিয়া।
ফুলের দোকান কি খুলেছে?
এত সকালে কি খুলবে।
পান্না ভাবী নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে বরং একটু পরেই যাই। তুমি চা করতো রাত্রি। তোমার সঙ্গে বসে চা খাই। শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে। কাল রাতে কি হয়েছে শোন –রাত এগারোটার সময় মার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হল। অকারণে মার সঙ্গে খানিকক্ষণ রাগারাগি করলাম। সাংঘাতিক মাথা ধরল। রাগ কমানোর জন্যে ছটা হিপনল খেয়ে শুয়েছি– এক ঘুমে রাত কাবার।
আমি মনে মনে হাসলাম। কাল রাতের ব্যাপার পান্নাভাবী সবই জানেন। এটা কাটান দেয়ার জন্যেই ঘুমের ট্যাবলেট হিপনলের কথা নিয়ে এসেছেন।
আমি চা বানাচ্ছি– পান্না ভাবী আমার সামনে মোড়ায় বসে আছেন। আমি যতদূর জানি পান্নাভাবী চা খান না। চা খাওয়ার এই ভণিতার পেছনেও নিশ্চয়ই কোন করাণ আছে। কে জানে কি সেই কারন।
রাত্রি!
জি ভাবী।
তোমাকে আমি আমার ছোটবোনের মত মনে করি।
আমি জানি ভাবী।
না তুমি জান না। তোমাকে যে আমি কতটা ভালবাসি তা আমি জানি। অন্য কেউ জানে না। অন্য কারোর জানার কথাও না। আমিতো আর আমার মনের কথা শহরে ঢোল দিয়ে সবাইকে বলব না —
তাতো বটেই।
নিতান্ত আপনজন ভেবে আমি তোমাকে কয়েকটা কথা বলব বোন।
আমি শংকিত গলায় বললাম –বলুন। আমার ভয় হচ্ছে পান্না ভাবী কাল রাতের ব্যাপারটা তুলে আনেন কি-না। তিনি গলা অনেকখানি নামিয়ে ফিস ফিস করে বললেন –তুমি কি ইদানীং আমার কাজের মেয়ে রাণীকে লক্ষ্য করেছ?