আমি নিজের অজান্তে হঠাৎ বলে ফেললাম, স্লামালিকুম নাজমুল ভাই। উনি চমকালেন না। অবাক হলেন না। আমাকে অবাক করে দিয়ে স্বাভাবিকভাবে বললেন –তুমি এত রাত পর্যন্ত জেগে আছ যে?
আমি তো খুব রাত জাগি।
তা জানি।
জানেন? আশ্চর্য তো! আমি ভেবেছিলাম –আপনি শুধু আপনার বই এবং লেখার খাতায় কি ঘটছে তা জানেন। আর কিছু জানেন না।
নাজমুল সাহেব আবারো আমাকে অবাক করে দিয়ে শব্দ করে হাসলেন। এই প্রথম দেখলাম তিনি সিগারেট দুটা টান দিয়ে ফেলে দিলেন না। বারান্দার রেলিঙে ঝুঁকে গল্প করবে লাগলেন —
এম. এ. পাশ করার পর কি করবে কিছু ঠিক করেছ?
জি করেছি।
কি করবে?
ঘুমাব। আরাম করে ঘুমাব।
আরাম করে তো এখনো ঘুমুতে পার। এখন তো আর পড়াশোনা নেই।
পড়াশোনা না থাকলেও টেনশন আছে। পাশ করব কি করব না।
কি বলছ তুমি! খুব ভাল পাশ করবে তুমি। যে ভাবে পড়াশোনা কর তাতে খারাপ রেজাল্টের কোন সম্ভাবনা নেই
আমি কি খুব পড়াশোনা করেছি।
দিন রাতই তো দেখতাম পড়ছ।
আপনি চারপাশে কি ঘটে তা লক্ষ্য করেন? আশ্চর্য!
তিনি আবারো শব্দ করে হাসলেন। আর তখন ঘুম ভেঙে বাবলু উঠে এসে বলল, আপা, ভাত দে। খিদে।
রাত বাজে কটা জানিস?
কটা?
প্রায় তিনটা।
তিনটার সময় ভাত খাওয়া যাবে না –এমন কোন কথা আছে? আছে এমন। কোন আইন? থাকলে বল– পেনাল কোডের কোন ধারায় আছে?
আমি রাত তিনটায় বাবলুর জন্যে ভাত বাড়তে গেলাম। অনেক যন্ত্রণা করতে হবে। ঠাণ্ডা ভাত সে খাবে না। ভাত গরম করতে হবে। তরকারী গরম করতে হবে। সালাদ বানাতে হবে। খেতে বসে বলে বসতে পারে –মাছ খাব না, ডিম ভেজে দে। ঘরে ডিম আছে কি-না তাও জানি না।
বাবলু গোগ্রাসে খাচ্ছে। তার খুব যে খিদে পেয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। সন্ধ্যারাতে সে কি কাণ্ড করেছে তাও বোধহয় তার মনে নেই।
আপা, একটা ডিম ভেজে দে।
ডিম নেই।
সামান্য একটা ডিমও ঘরে থাকে না?
থাকে। আজ নেই।
আজ নেই কেন? সংসারে আমরা তিনটা মোটে মানুষ, একটা কাজের লোকও নেই। মাসের শেষে ছ’ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া পাস। যায় কোথায় টাকাটা?
কথা বলিস না। চুপ করে খা।
চুপ করে খাব কেন? আমি একটা প্রশ্ন করেছি। আমি তার আনসার চাই। গিভ মি এন এক্সপ্লেনেশন।
ওর সঙ্গে কথা বলা নিরর্থক। আমি চুপ করে রইলাম –সে ভাতের থালা সরিয়ে দিয়ে বলল, –যা, খাব না তোর ভাত।
না খেলে উঠে যা।
আমি উঠব কি উঠব না সেটা আমার ব্যাপার।
তাহলে বসে থাক। আমি চললাম।
বাবলু বলল, তোর দেমাগ খুব বেশি হয়ে গেছে, সেটা কি তুই জানিস? তুই ডুবছিস তোর দেমাগের জন্যে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। তোর হাসবেন্ড যে ঘাড় ধরে তোকে বার করে দিয়েছে –তোর দেমাগের জন্যে বার করে দিয়েছে। অন্য কিছু না। এ বাড়িতে তুই পড়ে আছিস আমার দয়ার উপর। আর কিছু না।
আমি তাকিয়ে আছি বাবলুর দিকে। এইসব কি নেশাগ্রস্ত মানুষের কথা? নাকি তার মনে এই ব্যাপারগুলি আছে? নেশার কারণে বের হয়ে আসছে?
নিজের ছেলেকে তুই ঈদের দিনেও চোখের দেখা দেখতে পারিস না। কেন পারিস না? তোর দেমাগের জন্যে।
চুপ কর বাবলু।
বাবুল চুপ করল। আমি শান্ত ভঙ্গিতে থালা-বাসন সরালাম। টেবিল মুছলাম। বাবলু বলল, পানি খাব।
আমি পানি এনে দিলাম। সহজ গলাতেই বললাম, চল ঘুমুবি। বাবলু আপত্তি করল না। উঠে এল। আমি শুয়ে পড়লাম নিজের ঘরে। হঠাৎ খুব ক্লান্তি বোধ করছি। মনে হচ্ছে অনেকদিন ঘুমুইনি। অনেকদিন পর যেন আজ প্রথম ঘুমুতে যাচ্ছি। খুব ক্লান্ত মানুষ ঘুমুতে পারে না। আমিও ঘুমুতে পারছি না। ঘুমুতে না পারার আরেকটা বড় কারণ হল, বাবলু ঠিক আমার ঘরের সামনে হাঁটাহাঁটি করছে। শব্দে করে হাঁটা, ইচ্ছা করেই যেন এত শব্দ করছে। শুধু যে শব্দ করে হাঁটছে তা না, চেয়ার পরেও টানাটানি করছে। সম্ভবত সে চাচ্ছে আমি বলি –শব্দ করছিস কেন? যাতে সে আরেকটা ঝগড়া বাধাবার সুযোগ পাবে।
এখন আমার দরজায় ধাক্কা পড়ছে। আমি বললাম, কি হয়েছে বাবলু?
একটু দরজা খুলবি আপা?
কেন?
খুব জরুবী একটা কথা বলব। খুবই জরুরী। এক মিনিট লাগবে।
সকালে শুনব।
সকালে না আপা –এখন শুনতে হবে।
বাবলু, তুই খুব বিরক্ত করছিস।
দরজা না খুললে আমি আরো বিরক্ত করব। লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে ফেলব।
ধমাধম শব্দে দরজায় লাথি পড়তে লাগল। শব্দে নিশ্চয়ই পাড়া জেগে উঠেছে। পান্নাভাবী বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে আছেন কি হচ্ছে শোনার জন্যে। আমি বাবার চটির শব্দ শুনলাম। বাবা কঠিন গলায় কখনো কথা বলতে পারেন না। আজও পারলেন না –নরম গলায় বললেন, কি হয়েছে রে?
বাবলু কোন শব্দ করল না। বাবা বললেন –তুই আমার সঙ্গে আয়।
কোথায় যাব?
আমার ঘরে আয়। তোর সঙ্গে কথা বলি।
রাত-দুপুরে কি কথা? রাত-দুপুরে যদি দরজা ভাঙাভাঙি করা যায় তাহলে কথাও শোনা যায়।
উপদেশ শুনতে ভাল লাগে না, বাবা।
উপদেশ শুনতে হবে না। আয় তুই।
না আমি যাব না। আমাকে সে দুই চোখে দেখতে পারে না। কেন পারে না? আমি কি করেছি? আমি হয়েছি দুনিয়ার খারাপ, সে হয়েছে মহিলা-ফেরেশতা। সে যে একজন বিবাহিত লোকের সঙ্গে রাত তিনটার সময় প্রেম করে সেটা কিছু না?
বাবা ক্লান্ত গলায় ডাকলেন, বাবলু!
বাবলু পাত্তা দিল না। গলার স্বর আরো উঁচিয়ে বলল, আমি কিছু করলেই দোষ হয়ে যায়। কারণ আমি নন্দঘোষ। যত দোষ নন্দঘোষ। আপার কোন দোষ নেই। সে মহাপবিত্র। রাত তিনটায় প্রেম করলেও কিছু না –বিবাহিত মানুষের সঙ্গে ট্যাক্সি করে ঘুরলেও কিছু না।