গুড, ভেরি গুড।
বাবা যখনই কথা বলার কিছু পান না, তখনই আমার পরীক্ষার রেজাল্ট কবে হবে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্রায়ই আমাকে আমার পরীক্ষার রেজাল্ট কবে হবে তা বলতে হয়।
বাবলুকে নিয়ে কি করা যায় বল তো?
বাড়ি থেকে বের করে দাও। ঘাড় ধরে বের করে দাও।
তুই তো মা রাগের কথা বলছিস। চিন্তা-ভাবনা করে কিছু বল।
চিন্তা-ভাবনা করেই বলছি।
বাবা ঘুমুতে গেলেন রাত বারোটার দিকে। বারোটার আগে তিনি কখনোই ঘুমুতে যান না। বারোটার পর তিনি তাহাজ্জুতের নফল নামাজ পড়েন। এই নামাজ রাত বারোটার পর পড়তে হয় বলে তাকে বারোটা পর্যন্ত জেগে থাকতে হয়।
বাবার ঘুমুতে যাবার পরও আমি অনেক রাত পর্যন্ত একা একা বারান্দায় বসে রইলাম। আমাদের দোতলার দক্ষিণ অংশের ভাড়াটে নাজমুল সাহেবের বাড়িতে অনেক রাত পর্যন্ত বাতি জ্বলে। নাজমুল সাহেব গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা এবং লেখালেখি করেন। মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে তিনি বারান্দায় এসে সিগারেট ধরান। দু তিনটা টান দিয়েই সেই সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে আবার ঘরে ঢুকে যান। নাজমুল সাহেবরা অনেকদিন থেকেই আমাদের বাড়িতে আছেন। এত দীর্ঘদিন কেউ থাকলে তার সঙ্গে সহজ সম্পর্ক হয়ে যাওয়ার কথা। এই ভদ্রলোকের সঙ্গে হয়নি। তিনি কারো সঙ্গেই কথা বলেন না। সম্ভবত নিজের স্ত্রীর সঙ্গেও না। রাস্তায় হঠাৎ আমার সঙ্গে দেখা হলে ঝট করে চোখ ফিরিয়ে নেন কিংবা রাস্তার দিকে তাকিয়ে হাঁটতে। থাকেন যাতে চোখে চোখ না পড়ে কিংবা কথা বলতে না হয়। তাকে স্লমালিকুম দিলে তিনি বেশির ভাগ সময়ই না শোনার চেষ্টা করেন। সেটা সম্ভব না হলে উ ঊ বলে মাথা নাড়েন। পরিবারে একজন অস্বাভাবিক মানুষ থাকলে তার ছোঁয়া অন্য সবার মধ্যেই পড়ে। সেই জন্যেই বোধহয় নাজমুল সাহেবের স্ত্রী পান্না ভাবীর স্বভাবও খানিকটা বিচিত্র। তিনি প্রচুর কথা বলেন। প্রচুর গল্প করেন –সেই সব গল্পের সবই হল ভয়ংকর ধরনের গল্প। কোথায় কে কাকে খুন করেছে এই জাতীয় গল্প। নিখুঁত বর্ণনা। স্বামী সম্পর্কেও তিনি প্রচুর গল্প করেন, যেসব গল্প কোন সুস্থ মাথার স্ত্রী তার স্বামী সম্পর্কে কখনো করবেন না–
তোমার ভাইকে বাইরে থেকে ফেরেশতার মত মনে হয় না? ফলস ফেরেশতা। আসল জিনিস না, নকল। পুরোটাই মুখোশ। রাত-দিন বই পড়ে, লিখে –মনে হবে, বাবা, কি বিরাট স্কলার! নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। আসলে ফলস স্কলার। মুখের সামনে বই ধরে রাখলেই স্কলার হয় না। মুখের সামনে বই ধরে রাখে কেন জান? যাতে আমার সঙ্গে কথা বলতে না হয়। আমার কথা বিশ্বাস করলে না, তাই না? ভাবছ, পান্না ভাবী বানিয়ে বানিয়ে কথা বলছে। আমি নিজেও এটা শুরুতে ধরতে পারিনি। শুরুতে আমার মনে হয়েছিল– আহা, কত বড় স্কলারকে বিয়ে করেছি। আমার জীবন ধন্য। পরে বুঝলাম, সবই ভান। ওর। সবটাই ভান। পায়ের নখ থেকে মাথার চল পর্যন্ত ভান। ও যে নিঃশ্বাস ফেলে সেই নিঃশ্বাসটা পর্যন্ত ভান। ও হচ্ছে ভান-সম্রাট।
রাস্তায় তোমার সঙ্গে দেখা হলে চোখ তুলে তাকাবে না। সালাম দিলে –সালাম। পর্যন্ত নিবে না। কিন্তু তলে তলে মেয়েমানুষ দেখার জন্যে শুধুই ছোঁক ছোঁক করে। বাসায় কাজের মেয়ে-টেয়ে যে রাখি ওর নজর সেই দিকে। এরা সারাদিন কাজ করে, রাতে মরার মত ঘুমায়। ঘুমের সময় তো আর সব সময় কাপড়-চোপড় ঠিক থাকে না –এই হয়ত পা থেকে শাড়ি খানিকটা ওঠে গেল, বা ব্লাউজের একটা বোতাম খুলে গেল। তোমার ভাইয়ের তখন ঈদ উৎসব। হা করে তাকিয়ে থাকবে। চোখে পলক পড়বে না। তার ধারণা কেউ কিছু জানে না। আমি তো বিছানায় শুয়ে ঘুমুচ্ছি। আমি দেখব কি? সে তো জানে না –আমি জেগে থাকি। মটকা মেরে পড়ে থাকি। স্পাইয়ের মত পা টিপে টিপে একবার এসে দেখে যাই। কি দেখি জান? দেখি, আমাদের স্কলার সাহেব হা করে বোতাম খোলা ব্লাউজের দিকে তাকিয়ে আছেন। কাজের মেয়েরা তো আর ব্লাউজের নিচে কিছু পরে না। ওদের ব্লাউজের বোতাম খোলো মানে অনেক কিছু। আমি করি কি –আড়াল থেকে দেখে চলে আসি। কিছু বলি না। একেবারেই যে বলি না তা না –একবার বললাম, কি দেখছ?
সে আমার দিকে তাকিয়ে স্কলারের মত গলায় বলল –প্রাচীন ভারতে চারটা ক্লাস ছিল –ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র। এই ক্লাসগুলি এখনো আছে। প্রবলভাবেই আছে। এই মেয়েটাকে দেখ আজকের ক্লাস সিস্টেমে সে শুদ্র। অস্পৃশ্য।
অস্পৃশ্য কে বলল –ওকে ছুঁয়ে দিলে কিছু হবে না। যাও, ছুঁয়ে এসো।
স্কলার সাহেব এমনভাবে তাকালেন যেন আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমার চিকিৎসা দরকার। আসল চিকিৎসা কার দরকার তা জানি শুধু আমি … ।
.
নাজমুল সাহেবকে দেখছি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছেন। তার স্ত্রীও নিশ্চয়ই আড়াল থেকে লক্ষ্য করছেন। ছায়ার মত পেছনে পেছনে আছেন। লক্ষ্য না করার কথা না। আজকে যে নাটক বাড়িতে হল সেই নাটকের পুরোটা পান্নাভাবী জানেন, এটাও নিশ্চিত।
বারান্দায় আলো নেই। আমি অন্ধকারে বসে আছি। আমাকে ভদ্রলোক দেখতে পারছেন না। আমি তাকে দেখছি। স্নামালিকুম বলে আমি ভদ্রলোককে চমকে দেব না-কি? স্নামালিকুম বললে উনি কি করবেন? উ ঊ জাতীয় শব্দ করে এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে যাবেন?