.
০২.
এখনকার বখা ছেলেরা গলায় রুমাল বাধে না। কিন্তু বাবলু গলায় লাল রঙের একটা স্কার্ফ জড়িয়েছে। ভিডিও দোকানের বারান্দায় কয়েকটা চেয়ার এবং একটা টুল একত্র করে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। মনে হয় আকাশের সৌন্দর্যে সে মুগ্ধ। আমি তাকে দেখেও না দেখার ভান করলাম। সে আকাশ দেখছে, দেখুক। এমন প্রকৃতিপ্রেমিককে বিরক্ত করা ঠিক না। আমি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি– বাবলু তড়াক করে উঠে বসে বলল –আপা, কোথায় যাচ্ছিস?
আমি দাঁড়ালাম কিন্তু জবাব দিলাম না। জবাব দেয়ার কিছু নেইও। আমি কোথাও যাচ্ছি না। রাস্তায় ঘুরতে বের হয়েছি। রিকশায় করে শহরে ঘুরব। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে এক সময় ফিরে আসব। বাবলু উদাস গলায় বলল, গুলিস্তানের দিকে যাবি না, হেভী গ্যাঞ্জাম হচ্ছে। টিয়ার গ্যাস ফাটাফাটি। দু’জন স্পট ডেড।
বাবলু আশা করেছিল আমি জানতে চাইব কি নিয়ে গ্যাঞ্জাম। জিজ্ঞেস করলে সে দীর্ঘ এক গল্প ফাদার সুযোগ পেয়ে যেত। সে সুযোগ তাকে দেয়া যায় না। আমি দরদাম ঠিক না করেই একটা ফাঁকা রিকশায় উঠে পড়লাম। বাবলু আহত চোখে তাকিয়ে আছে। থাকুক। যা ইচ্ছা করুক। ওর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
পরশু রাতে সে বাসায় ফিরেছে মদ খেয়ে। চোখ লাল, মুখের কথা জড়ানো। হাঁটা দূরের কথা –ঠিকমত দাঁড়াতেও পারছে না। বাবা হতভম্ভ হয়ে বললেন, তোর কি হয়েছে? বাবলু আনন্দিত গলায় বলল, নাথিং। কিছুই হয়নি।
শরীর খারাপ নাকি রে?
শরীর খারাপ না। শরীর ভাল। মনটা হেভী খারাপ।
বাবা কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি বললাম, বাবা, ও মদ খেয়ে এসেছে।
বাবা হতভম্ভ গলায় বললেন, সে কি?
তিনি বোধহয় তার আটষট্টি বছরের জীবনে এত বিস্মিত আগে আর হননি। তিনি একবার বাবলুর দিকে তাকাচ্ছেন, একবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন। বাবলু যদি এখন বলে –আপা মিথ্যা কথা বলছে, আমি মদ খাইনি, তাহলে তিনি তার। কথাই বিশ্বাস করবেন।
মাতালরা সত্যবাদী হয়, কাজেই বাবলু সত্যি কথাই বলল –দাঁত বের করে বলল, খুব সামান্য খেয়েছি বাবা। টেস্ট করেছি। বন্ধুবান্ধবরা ধরল। না বলতে পারলাম না। মনটাও ছিল হেভী উদাস।
বাবার বিস্ময় কাটছে না। বাবলু যেমন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না, দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে, বাবারও সে রকম অবস্থা। তিনিও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। অল্প অল্প কাঁপছেন। আমি বললাম, বাবা, তুমি ওকে বল বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। আর কখনো যেন এ বাড়িতে না ঢুকে।
বাবলু চোখ লাল করে বলল, চলে যাব কেন? এটা কি তোর একার বাড়ি? তোর যেমন রাইট আছে, আমারো রাইট আছে। তোর হাফ রাইট, আমার ফুল রাইট। আন্ডারস্ট্যান্ড?
বলতে বলতে বাবলু বসে পড়ল এবং বিকট শব্দে বমি করতে লাগল। বমির সঙ্গে তার নাড়িভুড়ি পর্যন্ত উঠে আসছে এমন অবস্থা। বাবা বসে দুহাতে বাবলুর মাথা ধরলেন। বাবলু তার গায়েও বমি করল।
বমি করার ফাঁকে ফাঁকে বাবলু বলল, গরম পানি লাগা তো আপা। হেভী গোসল দিতে হবে। শালা মাখামাখি হয়ে গেছি। ঘরে সাবান আছে না?
এই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখা মুশকিল। আমি রান্নাঘরে এসে চুলায় পানি চড়িয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। পানি ধীরে সুস্থে গরম হোক। আমি বসে থাকব। ঘরে যে কাণ্ড ঘটছে তা দেখতে ইচ্ছা করছে না।
বাবা রান্নাঘরে ঢুকে বললেন, গরম পানি কি হয়েছে খুকী?
হচ্ছে।
তিনি ইতস্ততঃ করে বললেন, ছেলেমানুষ একটা ভুল করে ফেলেছে। বদ বন্ধু বান্ধব জুটলে যা হয়। তুই মন খারাপ করিস না।
আমি মন খারাপ করছি না। আমার জন্যে তোমাকে ব্যস্ত হবে হবে না।
বাজে কিছু বন্ধু বান্ধব জুটেছে –ওরাই …?
তোমাকে সাফাই গাইতে হবে না, বাবা।
মা, তুই রাগ করিস না– রাগ করিস না।
আমি রাগ করছি না। পানি গরম করছি।
আচ্ছা মা, আচ্ছা।
বালতি ভর্তি গরম পানি নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখি বাবা এর মধ্যেই বাথরুম থেকে পানি এনে নোংরা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে ফেলেছেন। বাবলুকে কলঘরে একটা জলচৌকির উপর বসিয়ে রেখেছেন। বাবলু শান্তমুখে বসে আছে। আমাকে দেখে বলল, আপা, গরম পানি বাথরুমে দিয়ে যা।
বাবলুকে বাবা গোসল করালেন। আমি কলঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখলাম। বাবলুর চোখে-মুখে লজ্জা বা অস্বস্তির বিন্দু মাত্র নেই। মনে হচ্ছে সে বেশ আনন্দ পাচ্ছে। মাঝে মাঝে মুখে পানি নিয়ে কুলকুচা করে সেই পানি অনেক দূরে ছিটাচ্ছে। বাবা বললেন –শরীর খারাপ ভাবটা কি দূর হয়েছে?
বাবলু খুশিখুশি গলায় বলল, শরীর তো আমার ঠিকই আছে। মনটা হেভী খারাপ। সাবান দিয়ে গোসল করলে তো আর মন-খারাপ ভাব দূর হয় না?
কি জন্যে মন খারাপ সেটা সকালে শুনব। এখন বাতি নিভিয়ে লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে থাক। কিছু খাবি?
পান খাব, বাবা। মুখ টক হয়ে আছে।
ঘরে পান ছিল না। বাবা নিজেই পান কিনে আনলেন। সেই পান বাবলু খেতে পারল না। তার আগেই ঘুমিয়ে পড়ল। নাক ডাকিয়ে ঘুম।
রাতে আমরা দুজনই কিছু খেলাম না। বমি ঘাঁটার জন্যে বাবার কিছু খেতে ইচ্ছা করছিল না। আমার খেতে ইচ্ছা করছিল না রাগের জন্যে।
আমি এবং বাবা, আমরা দুজন অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে রইলাম। দু’জনই চুপচাপ। একবার বাবা বললেন, তোর এম. এ. পরীক্ষার রেজাল্ট কবে হবে? আমি বললাম, সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে।