বাবলুর সবকিছুই সাময়িক। হৈ-চৈও সাময়িক। কিছুক্ষণ হৈ-চৈয়ের পর সে সহজ স্বাভাবিক মানুষ। খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুমুচ্ছে। আমি বাসায় থাকায় তাকেই সবচে’ খুশি মনে হয়। খুশিটা সে গোপন করে না।
তুই যে এখানে আছিস –খুব ভাল হয়েছে। বাসাটা শুশানের মত ছিল। আমি আর বাবা এত বড় একটা বাড়ি– চিন্তা কর অবস্থা! এখন ফাইন হয়েছে। তাছাড়া কোন বাড়িতে মহিলা না থাকলে বাড়িটা ছেলেদের হোস্টেল হয়ে যায় — সব মন্দের একটা ভাল দিক আছে। তুই এখানে আছিস, এর মারাত্মক একটা ভাল দিক আছে …।
আট মাসের মাথায় মামুনের চিঠি পেলাম। ভুল বললাম, মামুনের চিঠি না –মামুনের উকিলের চিঠি। গাধা চিঠি। এরকম চিঠি এডভোকেট সাহেব নিশ্চয়ই অনেককে পাঠিয়েছেন। চিঠিতে কোর্টের দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর প্রক্রিয়ায় না গিয়ে দু’জন একত্রে কাজি অফিসে উপস্থিত হয়ে তালাকনামা প্রস্তুতের সুপারিশ করা হয়েছে।
আমি উকিলের চিঠি বাবাকে দেখালাম। বাবা বললেন, কি করবি? যাবি?
আমি হা-সূচক মাথা নাড়লাম।
যা করছিস ভেবে-চিন্তে করছিস তো?
হ্যাঁ।
বাবা শ্রান্তস্বরে বললেন, আচ্ছা।
বাবা সেদিন যদি শুধু ‘আচ্ছা’ শব্দটা না বলে অন্যকিছু বলতেন তাহলে আমার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হত কি? হয়ত হত। বাবার কথা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই– বাবা এই ব্যাপারটা জানেন বলেই বোধহয় শুধু বললেন –আচ্ছা। মা বেঁচে থাকলে তিনি কি করতেন? ভয়ংকর এইসব ঘটনায় হাসির কিছু খুঁজে পেয়ে হয়ত হেসে ফেলতেন। ছোটবেলায় ফুটবল খেলতে গিয়ে বাবলু হাত ভেঙে বাসায় ফিরল। বন্ধু বান্ধব ধরাধরি করে নিয়ে আসছে। বাবলু কিছুক্ষণ পর পর ঠোঁট গোল করে ওহোহো ওহোহো জাতীয় শব্দ করে কাঁদছে। মা বললেন –বাবলু, তুই এমন। ইংরেজি ভাষায় কাঁদছিস কেন? বলেই হেসে ফেললেন। মা’কে সেদিন আমার খুব নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল। এখনো মনে হয়।
কাজি অফিসে মামুন এসেছিল সিল্কের একটা হাওয়াই শার্ট পরে। ধবধবে সাদা জমিনের উপর হালকা সবুজ পাতার ছাপ দেয়া শার্ট। ক্রীম কালারের প্যান্ট। চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো। মুখও হাসি-হাসি। যেন সে কোন একটা উৎসবে এসেছে। তার সঙ্গে অফিসের কয়েকজন কর্মচারি। বাইশ-তেইশ বছরের হালকা পাতলা গড়নের একটা মেয়েও সঙ্গে আছে। সেও সম্ভবত অফিসেরই কেউ হবে। স্যার স্যার বলছে। মামুন হয়ত ইচ্ছা করেই মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। আমি রিকশা থেকে নামতেই সে এগিয়ে এল। সহজ ভঙ্গিতে হাসল। একজন হাসলে উত্তরে। অন্যজনকেও হাসতে হয়। আমি হাসতে পারলাম না। কেন জানি নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল।
মামুন বলল –কি, ভাল?
আমি মাথা নাড়লাম।
কাগজপত্র সব রেডি করা আছে। দু’জন শুধু একসঙ্গে যাব –সই করব। দ্যাটস অল। তোমাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমার লইয়ারকে একটা জিনিস জানতে পাঠিয়েছি। ও এসে পড়বে। তুমি আস আমার সঙ্গে। কাজি সাহেবের অফিসে একটা আইসোলেটেড ঘর আছে– সেখানে বোস। চা-টা কিছু খাবে?
না। টুকুন কেমন আছে?
ভাল আছে বলেই তো মনে হয়।
ভাল আছে কি-না তুমি জান না?
গত পরশুর খবর জানি –ভাল আছে। ও তো এখানে থাকে না। আমার বড়বোনের সঙ্গে ওকে ইংল্যাণ্ড পাঠিয়ে দিয়েছি। আপাতত সে বোনের সঙ্গেই আছে। চার বছর হলে পাবলিক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব।
আমাকে তুমি কিছুই জানাওনি।
তোমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি।
আমার নিজের ছেলে — সে কোথায় থাকবে, কোথায় থাকবে না তা আমি জানব না?
তোমাকে আগেও বলেছি। এখনো বলছি। তোমার না জানাই ভাল। তোমাদের ভেতর যোগাযোগ থাকলে –তোমার জন্যও সমস্যা, তার জন্যেও সমস্যা। আমি সমস্যা পছন্দ করি না। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করি সমস্যা কমাতে। আমার কাছ থেকে শেখার কিছু নেই– কিন্তু এই ব্যাপারটা শিখতে পার।
আমি কোনদিন আমার বাচ্চাকে দেখতে পারব না?
পারবে। দেখতে পারবে না এমন কথা তো হচ্ছে না। তবে তার আগে আমাকে নিশ্চিত হতে হবে যে, এখন দেখাদেখি হলে সমস্যা হবে না। ভাল কথা, তুমি যদি টুকুনের অভিভাবকত্ব দাবি কর তাহলে তোমাকে কিন্তু কোর্টে যেতে হবে। ডিভোর্স। স্যুট ফাইল করতে হবে। তাও তুমি করতে পার, আমার আপত্তি নেই।
কথা বলতে বলতে মামুন হাসছে। পরম শত্রুকে কোণঠাসা করার যে আনন্দ, মামুনের চোখে-মুখে সেই আনন্দ। আমার চোখে পানি এলে সে আরো আনন্দিত হবে। আমি যদি কাঁদতে কাঁদতে বলি, টুকুনকে আমার কাছে দিয়ে দাও, তাহলে সে নিশ্চয়ই মনের আনন্দে হেসে ফেলবে।
আমি তাকে সেই আনন্দ দিলাম না। সহজভাবেই কাগজপত্র সই করলাম। মামুন বলল –ভাল থেকো।
আমি বললাম, চেষ্টা করব।
মামুন হালকা গলায় বলল, টুকুনকে নিয়ে তুমি কোন দুঃশ্চিন্তা করবে না। ও ভাল আছে, ভাল থাকবে। টুকুন ঢাকায় এলে তোমাকে খবর দেব, তুমি এসে দেখে যেও।
ও কবে আসবে?
তা তো বলতে পারছি না।
ফেরার পথে আমি রিকশায় এলাম না। মামুন তার গাড়িতে করে আমাকে নামিয়ে দিল। পেছনের সীটে আমি এবং মামুন। সামনের সীটে ড্রাইভারের পাশে ওর অফিসেরই কোন কর্মচারি। মামুন সারাক্ষণই সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে ফ্যাক্টরির স্ট্রাকচারাল কি সমস্যা নিয়ে কথা বলতে লাগল। আমি যে তার পাশে বসে আছি এটা তার মনে রইল না।
সেই রাতেই আমি প্রথম স্বপ্নটা দেখলাম। রিকশা করে আমি এবং মামুন যাচ্ছি। আমার শাড়ি আটকে গেছে রিকশার চাকায়। মামুন রিকশা থামাবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। রিকশা থামছে না।