বাবলু রাগী গলায় বলল, অন্ধ বাবা ঘরে পড়ে আছেন এর মধ্যে তুই বিয়ের কথা তুললি। আশ্চর্য কান্ড। হার্ট বলে কোন বস্তু কি তোর নেই?
আমি হাসছি।
ঠিক মার মত হাসার চেষ্টা করছি।
.
১৪.
ভোরবেলায় বীনু এসে উপস্থিত। ওকে দেখেই মনে হচ্ছে ও সারারাত ঘুমুয়নি। চুল উস্কখুস্কু। চোখের নিচে কালি। মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে।
আমি বললাম, ব্যাপার কি বীনু?
বীনু ক্ষীণ স্বরে বলল, কিছু না।
কিছু তো বটেই, সেই কিছুটা কি?
আপা, পানি খাব।
আমি তাকে পানি এনে দিলাম। সে এক চুমুক দিয়েই গ্লাস নামিয়ে রাখল।
তুমি কি আমাকে কিছু বলতে এসেছ বীনু?
না।
আমার মনে হয় তুমি কিছু একটা বলতে এসেছ। বলে ফেল।
বীনু শুকনো গলায় বলল, বলতে পারছি না।
এমন কি ঘটল যে বলতে পর্যন্ত পারছ না?
বীনু নিচু গলায় বলল, ইস্তিয়াক সাহেবের বাবা-মা কাল সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় এসেছিলেন। তারা তাদের ছেলের জন্যে আমাকে পছন্দ করে গেছেন। ছেলেই নাকি তাদের পাঠিয়েছে। তারা চাচ্ছেন এক সপ্তাহের মধ্যে যেন বিয়েটা হয়। যাতে ভিসা নিয়ে আমি ইস্তিয়াক সাহেবের সঙ্গেই বাইরে চলে যেতে পারি।
বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে আমি বললাম, তোমার বাবা-মা দারুণ খুশি?
হ্যাঁ খুশি। মা কাল সারারাত নফল নামাজ পড়েছেন। বাবা মিষ্টি কিনে আমাদের যত আত্মীয়-স্বজন আছেন সবার বাড়িতে পাঠিয়েছেন। এখন আমি কি করব আপনি বলে দিন।
তুমি কি করবে তা তোমাকেই চিন্তা করে বের করতে হবে। আমি এখানে কেউ না।
আমি চিন্তা করে কিছু পাচ্ছি না। আপনি বলে দিন। আপনি যা বলবেন আমি তাই করব।
দেখ বীনু, ইস্তিয়াক চমৎকার ছেলে। জীবনে সে অনেক বড় হবে। আর আমার ভাই হচ্ছে বখা একটা ছেলে– তিনবার পরীক্ষা দিয়েও আই. এ. পাশ করতে পারেনি। কোন কিছুতেই তার স্থিরতা নেই। প্রায়ই নেশা করে বাড়ি ফেরে . . .
আপা প্লীজ, এই ভাবে বলবেন না।
সত্যকে সত্যের মত করেই বলতে হয় বীনু। মিথ্যা দিয়ে ঢেকে সত্য বলা যায় না।
উনি আমাকে খুব পছন্দ করেন।
বাবলু অবশ্যই তোমাকে পছন্দ করে। ইস্তিয়াকও কিন্তু করে। না করলে সে তার বাবা মাকে পাঠাতো না।
আমি কি করব আপা আপনি বলে দিন।
আমরা কেউ মহাপুরুষ না বীনু। আমরা সাধারণ মানুষ। আমরা আমাদের নিজেদের সুখই প্রধান করে দেখব। তোমারও তাই করা উচিত। ইস্তিয়াককে বিয়ে করলে তুমি অনেক সুখী হবে বলে আমার ধারণা। তবে তুমি আমার ধারণা মিথ্যাও প্রমাণ করতে পার। সাধারণ মানুষদেরও অসাধারণ সব ক্ষমতা থাকে।
বীনু বলল, আপা, আমি যাই।
আচ্ছা যাও।
এই প্রথম বীনু একবারও না হেসে আমাদের বাড়ি থেকে বিদেয় হল। বাবলু ঘর থেকে বের হয়ে বলল, বীনুর গলা শুনলাম। ওকি এসেছিল না-কি? আমি বললাম –না।
.
১৫.
মামুন পাজেরো জীপ পাঠিয়ে দিয়েছে। জীপের ড্রাইভার বিজ বিজ করে যা বলল তার অর্থ হল –আমি যেন এক্ষুণি চলে যাই। টুকুন অসুস্থ। দিনাজপুর থেকে ফিরেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে ভর্তি করা হয়েছে পিজি হাসপাতালে। অবস্থা ভাল না। অবস্থা খুবই খারাপ।
কি বলছে ড্রাইভার এসব? আমি ব্যাকুল হয়ে ডাকলাম –বাবলু! বাবলু। বাবলু ছুটে এল। যে ভীত গলায় বলল, আপা, কি হয়েছে?
আমি অস্পষ্ট স্বরে বললাম, আমার টুকুন মরে যাচ্ছে। আমার পাশে কেউ নেই। –তুই আমাকে হাত ধরে গাড়িতে তুলে দে–। বাবা ইজিচেয়ার থেকে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন –মা কি হয়েছে? কি হয়েছে? আমি বাবার কথার জবাব দিলাম না। আমার পৃথিবী শব্দ শূন্য হয়ে যাচ্ছে –বাবা আরো কি যেন বলছেন, আমি শুনতে পাচ্ছি না।
.
হাসপাতালের গেটে মামুন দাঁড়িয়ে। তার পাশে শান্ত চেহারার এই মেয়েটা কে? তার স্ত্রী? বাহ, মিষ্টি চেহারা তো মেয়েটির! কি লম্বা চুল।!
মামুন আমার কাছে এগিয়ে এল। সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল –টুকুনকে ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা হয়েছে। অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। ডাক্তাররা বলেছেন, অবস্থা ক্রিটিক্যাল। এই ধাক্কাটা কোনক্রমে যদি সামলাতে পারে তাহলে ওকে সঙ্গে সঙ্গে বাইরে পাঠিয়ে দেব। তুমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াও।
ওর কি জ্ঞান আছে?
হ্যাঁ, জ্ঞান আছে?
আমি ইনটেনসিভ কেয়ারে ঢুকলাম। আমার ছোট্ট বাবু কাত হয়ে শুয়ে আছে। তার নাকে অক্সিজেনের নল। বাবুর ছোট্ট বুক ওঠা-নামা করছে। দুজন ডাক্তার তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন বৃদ্ধ ডাক্তার দোয়া পড়ছেন। এটা কোন সূরা? সূরা ইয়াছিন? আমি বললাম, –আমি কি আমার বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বিছানায় বসে থাকতে পারি? অক্সিজেনের নল-টল যে রকম আছে সে রকম থাকবে। আমি কোন কিছুতেই হাত দেব না।
বৃদ্ধ ডাক্তার বললেন— আপনি আপনার ছেলেকে কোলে নিয়ে বসুন।
আমার কোলে তুলে দিতেই টুকুন চোখ মেলে আমাকে দেখল। আমি বললাম, বাবা, তোমার কোথায় ব্যথা?
সে তার বুক দেখিয়ে দিল।
আমি তার ছোট্ট বুকে হাত রাখলাম।
এখন আমি কি করব? প্রার্থনা? না, আমি কোন প্রার্থনা করব না। কেন আমি প্রার্থনা করব?
বাবা, ব্যথা কি খুব বেশি?
টুকুন তীব্র ব্যথা নিয়ে হাসার চেষ্টা করল। আমার সামনে মনিটার। সেখানে আলোর বিন্দু ওঠা-নামা করছে, জীবন এবং মৃত্যুর সীমা নির্দেশ করে যাচ্ছে। আমি তাকিয়ে আছি আমার টুকুনের দিকে।
আমি কাঁদব না। আমি কিছুতেই কাঁদব না।
মামুনকে ছেড়ে আসার সময় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম কোনদিন চোখের পানি ফেলব না। সেই প্রতিজ্ঞা আমাকে রাখতেই হবে। তাছাড়া আমাকে কাঁদতে দেখলে আমার সোনা ভয় পেতে পারে।