ঘুমের মধ্যেই ঠোঁট বাঁকিয়ে টুকুন কান্নার মত করছে। খুব যখন ছোট ছিল তখন সে এরকম করত। আমার বাবু কি কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে? না, আর দুঃস্বপ্ন নয়। আমার সোনামণির জীবন থেকে সব দুঃস্বপ্ন দূর হয়ে যাক। আমি নিচু হয়ে তার গালে চুমু খেলাম। টুকুনের বাকা ঠোঁট আবার ঠিক হয়ে গেল।
.
১৩.
ডাক্তার সাহেব আজ বাবার চোখের ব্যান্ডেজ খুলবেন। দশটায় ব্যান্ডেজ খোলার কথা, আমি এবং বাবলু সকাল সাতটা থেকে বসে আছি। বাবাকে খুব উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। তিনি ঘামছেন। একটু পর পর পানি খেতে চাচ্ছেন। তার তীব্র উদ্বেগের কারণ আমার কাছে স্পষ্ট হচ্ছে না।
বাবা বললেন, টুকুন কেমন আছে রে?
আমি বললাম, ও ভাল আছে বাবা।
ওকে নিয়ে এলে ভাল করতি। চোখ মেলেই টুকুনকে দেখতাম।
ও বাবা তার বাবার সঙ্গে দিনাজপুর গিয়েছে। কয়েকদিন ওদের গ্রামের বাড়িতে থাকবে। দিনাজপুর থেকে এসে আমাদের সঙ্গে থাকবে।
আমাকে চিনতে পারবে কিনা কে জানে!
চিনতে পারবে। চিনতে না পারার কি আছে?
চিনতে না পারলেও ক্ষতি নেই। দ্রুত ভাব করে ফেলব।
আমার মনে হল বাবা আজ যেন অন্যদিনের চেয়েও অনেক বেশি কথা বলছেন। এত কথা বলা তার স্বভাবে নেই। উদ্বেগের কারণেই কি কথা বেশি বলছেন?
বাবলুর সঙ্গেও বাবার অনেক কথা হল। বাবা নিজেই বললেন –বাড়ির প্ল্যান নাকি খুব সুন্দর হয়েছে?
বাবলু বলল –শুধু সুন্দর বললে ইস্তিয়াককে খাটো করা হয়। ইস্তিয়াক হচ্ছে একটা জিনিয়াস ছেলে। ও থাকলে ভাল হত, বাড়িটা সুপারভাইজ করতে পারত।
ও থাকছে না?
না থাকছে না। কানাডা চলে যাচ্ছে। সামনের মাসেই চলে যাচ্ছে। তোমাকে । বলিনি?
না।
খুব ভাল অফার পেয়েছে।
যাচ্ছে কবে?
সামনের মাসে। টিকিট এখনো কনফার্ম করেনি। অসাধারণ একটা ছেলে বাবা। আমার লোনের সব ব্যবস্থা করে গেছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। টাকাপয়সা কিচ্ছু নেয়নি। মডেল যে করেছে সেই মডেলের পয়সাও নেয়নি।
বলিস কি?
আমি কি ঠিক করেছি জান বাবা –একটা এপার্টমেন্ট ওকে আমি গিফট করব। আমার অনেক লস হয়ে যাবে। এপার্টমেন্ট মানে তো পঁচিশ-ত্রিশ লাখ টাকা। সহজ ব্যাপার না। তারপরেও মনস্থির করেছি।
ভাল।
টুকুনকেও একটা এপার্টমেন্ট দিয়ে দেব। মামার তরফ থেকে সামান্য উপহার। চারটা না, পাঁচ না, একটাই ভাগ্নে …।
টুকুন কি তোকে পছন্দ করেছে?
না। ডাকলে কাছে আসে না। আমার মধ্যে পছন্দ করার তো কিছু নেই।
বাবা হাসলেন। চোখ বাঁধা মানুষের হাসি সম্পূর্ণ অন্যরকম। হাসিটা কান্নার মত দেখায়। মানুষ হাসার সময় ঠোঁট এবং চোখ ব্যবহার করে। কাদার সময় শুধুই চোখ।
বাবলু বলল, বাবা, আমি কি ডিআইটি প্ল্যান জমা দিয়ে দেব?
দে।
তোমাকে সই করতে হবে। জমি তো তোমার নামে।
জমি আমি লিখে দিয়ে দেব। তবে তোর নামে লিখব না। তুই বিয়ে কর। তারপর তোর স্ত্রীর নামে লিখব। তোর নামে লিখলে তুই বিক্রি করে আমাদের সবাইকে পথে বসাবি।
বাবলু দরাজ গলায় বলল, আচ্ছা দেখা যাক। তোমার কাছে যেটা ভাল মনে হয় সেটাই করবে। বাড়িটা হলেই হল।
.
ডাক্তার সাহেব বাবার চাখের ব্যান্ডেজ খুললেন। শান্ত গলায় বললেন, দেখতে পাচ্ছেন?
বাবা বললেন, হ্যাঁ।
আমার আঙুলের দিকে তাকিয়ে বলুন কটা আঙুল।
বাবা ক্লান্ত গলায় বললেন –আমি দেখতে পাচ্ছি কিন্তু কিন্তু … কটা আঙুল ঠিক বুঝতে পারছি না।
আপনি সত্যি দেখতে পাচ্ছেন? ফাম্বল করবেন না, দেখতে পাচ্ছেন?
বাবা চুপ করে রইলেন।
.
আমরা অন্ধ বাবাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম। তাকে তার পুরানো জায়গায় — বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসিয়ে দিলাম। বাবা বললেন, তোরা আমার ব্যাপারে মোটেও মন খারাপ করবি না। চোখে অনেকদিন দেখেছি। অল্প কিছুদিন না দেখলে কিছু যায় আসে না। অন্ধ হবার কিছু সুবিধাও আছে। অন্ধদের কনসানট্রেশন ভাল হয়। এখন নামাজে যখন দাঁড়াব –খুব কনসানট্রেশন নিয়ে দাঁড়াব। খুকী, তুই বাবলুকে কান্নাকাটি করতে নিষেধ কর। ও ভেউ ভেউ করে কাঁদছে খুব বিরক্ত লাগছে। এ রকম মরাকান্নার কি আছে? তুই ওকে বুঝিয়ে শান্ত কর, আর বীনু মেয়েটাকে খবর দিয়ে নিয়ে আয়। ওকে দেখলে বাবলু তার হৈ-চৈ কান্না বন্ধ করবে। বাবলুকে আমার কাছে আসতে বল।
.
বাবলু কাঁদছে মার কবরের কাছে বসে। যেন সে তার কান্নাটা মাকে শুনাতে চায়।
আমি ডাকলাম, বাবলু!
বাবলু রাগী গলায় বলল, বিরক্ত করিস না আপা!
বাবা ডাকছেন।
বাবা ডাকলেই আমাকে যেতে হবে?
আমি বাবলুকে মার কবরের পাশে বসিয়ে রেখেই চলে এলাম। কাঁদুক, সবাই কাঁদুক। আমি কাঁদব না, আমি কিছুতেই কাঁদব না। আমি বরং হাসিমুখে বাবার সঙ্গে গল্প করব। আমি বাবার কাছে গিয়ে বললাম, চা খাবে বাবা?
খাব।
দুধ চা না লেবু চা?
দুধ চা।
.
রাতের বেলা অবাক হয়ে দেখি, বাবলু বালিশ হাতে বাবার ঘরের দিকে যাচ্ছে। আমি বললাম, ব্যাপার কি রে?
বাবলু ক্ষীণ স্বরে বলল, আমি বাবার সঙ্গে ঘুমুব। অন্ধ মানুষ। কখন কি দরকার হয়।
যা ঘুমো।
আর আমি ঠিক করেছি বাড়িঘর ভাঙব না। এই বাড়ির কোথায় কি আছে বাবা চেনেন –দেয়ালে ধরে ধরে যেখানে ইচ্ছা চলে যেতে পারবেন –তাই না?
আমি হাসলাম। বাবলু বিরক্ত হয়ে বলল, হাসছিস কেন? হাসির কি বললাম?
তুই ছেলেটা খারাপ না।
আমি খারাপ হব কেন?
বীনু তোকে বিয়ে করে সুখী হলেও হতে পারে। কিছু সম্ভাবনা আছে।