কার চিঠি?
জানি না কার। জিজ্ঞেস করিনি। আপা শোন, আমি ঠিক করেছি ডিআইটি প্ল্যান কালই জমা দিয়ে দেব। কাল ভাল দিন আছে– শুক্রবার।
শুক্রবারে অফিস বন্ধ থাকার কথা না?
ও আচ্ছা আচ্ছা। ভুলে গেছি। এত খুশি লাগছে, বুঝলি আপা –মাথা আউলা হয়ে গেছে — হা হা হা।
.
দামী খামের ভেতর ছোট্ট চিঠি। মামুন লিখেছে —
রাত্রি,
টুকুন এসেছে। কাল ভোরে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব। সারাদিন থাকুক। রাতে থাকতে চাইলেও রেখে দিতে পার। ব্যাগে অষুধপত্র আছে। কোন্টা কখন খাওয়াতে হবে তা লিস্ট করা আছে। ভাল থেকো।
–মামুন
এটা কি স্বপ্ন? আমি কি স্বপ্ন দেখছি। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে –অপ্রত্যাশিত যে আনন্দ আমি এই মুহূর্তে পেলাম সেই আনন্দের জন্যে আমি পৃথিবীর সমস্ত মানুষের সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিতে পারি।
টুকুন আসছে! টুকুন!
কত বড় হয়েছে টুকুন? তিন বছরে একটা শিশু কত বড় হয়? ও আমাকে দেখে প্রথম বাক্যটা কি বলবে? ও কি আমাকে লজ্জা পাবে? অষুধপত্রের কথা বলছে কেন? ওর কি অসুখ? আমার বাবুর অসুখ হবে কেন?
আমি সারারাত বারান্দায় বসে রইলাম। অসহ্য যন্ত্রণায় শরীর জ্বলছে। সেই যন্ত্রণাতেও তীব্র আনন্দ।
ঢাকা শহরের সব মানুষ ঘুমুচ্ছে। আমার ইচ্ছে করছে প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে যাই। ওদের ঘুম ভাঙিয়ে বলি –আপনারা ঘুমুচ্ছেন কেন? টকুন আসছে। টুকুন। আপনারা কেউ ঘুমুতে পারবেন না। আপনাদের সবাইকে জেগে থাকতে হবে।
.
১২.
দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে টুকুন দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে ধবধবে শাদা প্যান্ট, শাদা শার্ট। পায়ের জুতাজোড়াও শাদা –কিন্তু মোজা টকটকে লাল। তার হাতে একটা ইংরেজি ছড়ার বই। তার পাশে নীল রঙের বড়সর একটা ব্যাগ। আমি দোতলার সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি।
টুকুন বোধহয় লজ্জা পাচ্ছে। সে সরাসরি আমার দিকে তাকাচ্ছে না। একবার তাকিয়েই চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল। উঠোনে দুটা কাক বসেছে। সে এখন তাকিয়ে আছে কাকের দিকে।
আমি ডাকলাম –টুকুন!
টুকুন চমকে আমার দিকে তাকিয়ে আবার কাক দেখতে লাগল। আমি সিঁড়ির মাথাতেই দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে হচ্ছে আমার পা জমে গেছে। আমি নড়তে পারছি না।
টুকুন, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ?
সে কাকের দিকে তাকিয়ে থেকেই হা-সূচক মাথা নাড়ল।
আমি কে বল তো?
সে উত্তর দিল না। কাকটা উড়ে গিয়ে রান্নাঘরের বারান্দার কার্নিশে বসেছে। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে সেদিকে। কোন রকম আবেগ এই মুহূর্তে দেখানো ঠিক হবে না। তার সঙ্গে কথা বলতে হবে সহজ স্বাভাবিক গলায়। যেন সে কয়েক দিনের জন্যে বেড়াতে গিয়েছিল, এখন এসেছে। মাঝখানের দু বছরের কথা ভুলে যেতে হবে। আমার বাবুর ছোট্ট হৃদয় তীব্র আবেগ সহ্য করতে পারবে না। চিৎকার করে কাঁদবে। আমি তাকে কাঁদবে না। আমি নিজেও কাঁদব না। আমি এই পৃথিবীর সেরা অভিনেত্রীদের একজন। আমি আজ অস্কার পাওয়ার মত অভিনয় করব।
আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। টুকুনের সামনে দাঁড়িয়ে সহজ গলায় বললাম, তোমার হাতে এটা কি বই বাবা?
টুকুন বলল –রাইমের বই।
এই হচ্ছে আমার সঙ্গে তার প্রথম কথা। কি মিষ্টি গলা! শুধু কি মিষ্টি –একই সঙ্গে স্বরটা করুণ ও বিষণ্ণ।
বইটা কি তুমি আমার জন্যে এনেছ?
না।
তোমার জন্যে?
হ্যাঁ।
তুমি বই পড়তে পার?
হ্যাঁ।
এটা তো ইংরেজি বই, তুমি কি বাংলা পড়তে পার?
না।
আচ্ছা, তোমাকে আমি শিখিয়ে দেব। তুমি কি আমার কোলে উঠবে?
না।
এসো একটু কোলে নিয়ে দেখি।
কোলে উঠব না। ঐটা কি কাক?
হ্যাঁ কাক।
কাকটা এখানে বসে আছে কেন?
কাকটা তোমাকে দেখছে।
এই বাড়িতে কি মাছ আছে?
না।
আমাদের বাড়িতে মাছ আছে।
লাল মাছ?
একটা আছে কালো মাছ।
এসো তোমাকে একটু কোলে নেই।
না।
বাবা, তোমাকে কোলে নিতে ইচ্ছে করছে যে।
টুকুন দু হাত বাড়িয়ে দিল। আমি তাকে কোলে তুলে নিলাম –পাখির মত হালকা শরীর। এত রোগা কেন আমার ছোট্ট ময়না?
টুকুন দু হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে আছে। তার শরীর কাঁপতে শুরু করছে। আমার বাবু কাঁদছে। এত কান্না জমা ছিল তার ছোট্ট বুকে? কঁদুক, আমার বাবু কাঁদুক। আমি কাঁদব না। আমি কিছুতেই কাঁদব না। আমি শুধু পৃথিবীর না– এই বিশব্রহ্মাণ্ডের সব শ্রেষ্ট অভিনেত্রীর মত হাসিমুখে কথা বলে যাব। আমার বাবু যেন তার মার চোখের এক বিন্দু অশ্রুও না দেখে।
টুকুন দেখ দেখ, আরেকটা কাক এসেছে।
টুকুন মুখ গুঁজে আছে। সে এখন আর কিছুই দেখবে না। অপরূপ পৃথিবীর কোন দৃশ্য দেখারই এখন আর তার প্রয়োজন নেই।
টুকুন ঘুমুচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে সে আমার কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছি। ছড়ার বইটা এখনো তার হাতে ধরা। মনে হয় এই বইটা তার খুব প্রিয়। আমি টুকুনের পাশে বসে তার নীল ব্যাগ দেখছি। নীল ব্যাগে অনেক জিনিসের সঙ্গে খামে মোড়া একটি চিঠি আছে। চিঠিটা এই নিয়ে দ্বিতীয়বার পড়লাম। মামুন লিখছে–
টুকুনকে পাঠালাম।
তোমাকে কয়েকটা ব্যাপার বলা হয়নি। প্রধান ব্যাপারটা হল টুকুন অসুস্থ, ভাল রকম অসুস্থ। তাকে দেশের বাইরে দীর্ঘদিন রাখার পেছনের এটাই মূল কারণ। তোমাকে বলা হয়নি কারণ শুধু শুধু তোমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করাটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেছি। ওর হার্টে একটা অপারেশন হয়েছে– অপারেশটা ভাল হয়নি –আবারও করতে হবে। তার জন্যে তার শরীর সারানোর প্রয়োজন। ওকে দেশে আনা হয়েছে। তুমি ওর সঙ্গে থেকে –ওকে সঙ্গ দিয়ে ওর শরীর সারাবার ব্যাপারে সাহায্য করে।
আরো একটি জরুরি ব্যাপার তোমার জেনে নেয়া ভাল। আমি বিয়ে করেছি। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে এক রাতে তুমি টুকুনের খোঁজে আমার বাড়িতে এসে দেখলে একটা পার্টি হচ্ছে। পাটিটা ছিল বিয়ে উপলক্ষ দেয়া ঘরোরা পার্টি। তোমাকে এই খবর তখন দেইনি কারণ তুমি মনে কষ্ট পেতে।
আমি জানি তুমি শক্ত ও কঠিন ধরনের মেয়ে। জীবনের বাস্তবতাকে কষ্ট হলেও স্বীকার করে নেবার ক্ষমতা তোমার আছে।….