না। তবে বোঝার চেষ্টা করছি।
আমার টাইপিস্ট ফরিদাকে তুমি দেখেছ। তার প্রেমে আমার হাবুডুবু খাওয়ার কোন কারণ নেই তা বোধহয় তুমি ধরতে পারছ। পারছ না?
পারছি।
আমি যখন বাইরে যাই তখন সাইট সিইং-এর জন্যে যাই না। এটা কোন আনন্দের ভ্রমণ না, কাজের ভ্রমণ। সে সময় আমাকে কি পরিমাণ খাটুনি করতে হয় তা তোমাকে একবার নিয়ে দেখিয়ে আনব। যাই হোক, যে কথা বলছিলাম –পৃথিবীর সকল পুরুষ মানুষদের মতো আমারও কিছু শারীরিক চাহিদা আছে। আমি তো আর দেশের বাইরে গিয়ে প্রস্টিটিউট খুঁজে বেড়াতে পারি না। আমার সময়ও নেই, আগ্রহও নেই। ফরিদাকে এই কারণেই আমাকে নিয়ে যেতে হয়।
মামুন খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে সহজ ভঙ্গিতে সিগারেট ধরাল। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। কোন মানুষ এত সহজে এমন কথা বলতে পারে? সে কি করেই-বা ভেবে নিল এই কথাগুলো শোনার পর আমি স্বাভাবিক থাকব? মামুন বলল, কাউকে বল আমাকে হালকা করে কফি দিতে। চিনি যেন আধ চামচ দেয়।
আমি কফির কথা বলে এসে তার সামনে বসলাম। মামুনের ভুরু কুঁচকাল। সে বিরক্ত হচ্ছে। সে কি ধরেই নিয়েছিল তার সব কথাবার্তা হজম করে আমি শান্ত ভঙ্গিতে ঘুমুতে যাব?
মামুন বলল, কিছু বলবে?
হ্যাঁ।
ফরিদা প্রসঙ্গে?
না, ফরিদা প্রসঙ্গে না। আমার নিজের প্রসঙ্গে।
বল।
আমি তোমার সঙ্গে বাস করতে পারব না।
মামুন আমার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, কেন? আমি সত্যি কথা বলেছি বলে? সত্যবাদীর সঙ্গে বাস করা যায় না? সত্যি কথাটা না বললে তুমি কোনদিনই জানতে পারতে না।
আমি বললাম, তুমি ধরেই নিয়েছ আমার তোমাকে ছাড়া গতি নেই। এই জীবন আমার তোমার সঙ্গেই কাটাতে হবে। এই প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের কারণেই তুমি অনায়াসে কিছু কুৎসিত কথা আমাকে বলে ফেললে। এটা হল শুরু। এরপরে বাকি জীবনে তুমি আরো অনেক কুৎসিত কাজ করবে, আমাকে সেই সব সহ্য করতে হবে। তোমার সঙ্গে আমি নানা জায়গায় বেড়াতে যাব। পার্টিতে যাব। বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানে যাব। হাসিমুখে গল্প করব। সবাই বলবে– বাহ! মেয়েটা তো বেশ সুখী। এটা হতে দেয়া ঠিক হবে না।
কি চাও তুমি? সেপারেশন? ডিভোর্স?
আমি লক্ষ্য করলাম, এই কঠিন বাক্যটা বলার ফাঁকে মামুন ঠোঁট চেপে হাসল। সে ধরেই নিয়েছে আমি হাস্যকর কিছু কথা বলছি। মামুন হাই তুলতে তুলতে বলল, তুমি যা চাও তাই হবে। তুমি যদি প্র্যাকটিক্যাল মানুষের মত সব দিক বিবেচনা করে আমার সঙ্গে থাকতে চাও, থাকতে পার। শর্ত একটাই –আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না। আমার জীবনযাপনের কিছু বিশেষ পদ্ধতি আছে। তোমাকে সে সব মেনে নিতে হবে আর তুমি যদি চলে যেতে চাও, তাও যেতে পারবে।
আমি চলে যাব।
গুড। তোমাকে ছয় মাস চিন্তা করার সময় দেয়া হল। তুমি তোমার বাবার কাছে চলে যাও। ছ’মাস চিন্তা কর। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা কর –ছ’মাস পর তোমার যদি মনে হয় তোমার ডিসিসান ভুল ছিল, তুমি স্যুটকেস নিয়ে চলে আসবে। আমি একটি কথাও জিজ্ঞেস করব না। আর ছ’মাস পর যদি মনে হয় তোমার সিদ্ধান্ত সঠিক, তাহলে তো কথা নেই।
টুকুনকে আমি সঙ্গে নিয়ে যাব।
টুকুনের কথা এখানে আসছে কেন? আমি রক্ষিতা ধরনের একটা মেয়েকে নিয়ে দেশের বাইরে যাই এই সংবাদে টুকুন খুব চিন্তিত বলে তো মনে হয় না। টুকুন এখানেই থাকবে। আর এই ছ’মাস তুমি তার সঙ্গে দেখাও করবে না।
কেন?
সঙ্গত কারণেই করবে না। দুজনের দেখা-সাক্ষাত মানেই ভালবাসার ব্যাপারটা জিইয়ে রাখা। এতে পরবর্তী সময়ে টুকুনেরও কষ্ট হবে, তোমারও কষ্ট হবে। ভালবাসার বন্ধন পুরোপুরি কেটে যাওয়াই ভাল।
আমি যাতে এখানে থেকে যাই তার জন্যে তুমি এক ধরনের চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছ।
না। আমি প্র্যাকটিক্যাল মানুষ। আমি সমস্যাটা একজন বাস্তববাদী মানুষ হিসেবেই দেখার চেষ্টা করছি। আমাকে যদি ছেড়ে চলে যাও তাহলে তুমি বাকি জীবন একা একা কাটাবে, এটা আমি মনে করি না। আমার তো একা থাকার প্রশ্নই উঠে না। টুকুনকে দোটানায় রাখার কোন মানে নেই।
তুমি ওকে কি বলবে আমি মরে গেছি?
সস্তা উপন্যাসের ডায়লগ আমি বলি না। যেটা সত্যি সেটাই বলব।
আমি সেই রাতে এক মুহূর্তের জন্যে ঘুমুলাম না। পুরো রাত জেগে কাটালাম। মামুন আমার পাশেই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুল।
পরদিন দুটা স্যুটকেস হাতে বাবার কাছে চলে এলাম। বাবা বললেন –কি হয়েছে রে মা?
আমি হেসে বললাম, চলে এসেছি বাবা, তুমি আমাকে তোমার বাড়িতে থাকতে দেবে?
বাবা কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
ছ’মাস কেটে গেল। এই ছ’মাসে আমার কখনো ঐ বাড়িতে ফিরে যাবার ইচ্ছে হয়নি। টুকুনের জন্য কষ্ট হয়েছে। তীব্র কষ্ট। যে কষ্টের কোন সীমা-পরিসীমা নেই।
জীবন কাটছিল এক ধরনের ঘোরের মধ্যে। যেন আমি অসুস্থ। বোধশক্তিহীন মানুষ। খাচ্ছি, ঘুমুচ্ছি, চলাফেরা করছি।
আমার সমস্যা কি বাবা কোনদিন জানতে চাইলেন না। তবে মামুনের সঙ্গে তিনি। কথা বলতে গেলেন। তাদের মধ্যে কি হল তাও আমি জানি না। এম্নিতেই বাবা চুপচাপ। আরো চুপচাপ হয়ে গেলেন। তাঁর একমাত্র কাজ হল বারান্দায় জলচৌকিতে বসে খবরের কাগজ পড়া।
বাবলুর সঙ্গে বাসার কোন যোগ নেই –সে মাঝে মধ্যে খুব হৈ-চৈ করত –সংসারে এসব কি হচ্ছে? কি হচ্ছে এসব? বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে এরকম গুজব কেন কানে আসছে? আমি কিন্তু টলারেট করব না –ঐ লোকটার কানে ধরে আমি স্টেডিয়ামের চারদিকে চক্কর দেওয়ার। আমার এই পাওয়ার আছে। মারাত্মক সব লোকজনের সঙ্গে আমার কানেকশন আছে। ফজলু ভাইয়ের সঙ্গে সপ্তাহে তিন চারদিন এক টেবিলে চা খাই। ডেঞ্জারাস লোক। একদিন বাসায় নিয়ে আসব। বুঝলি আপা, আমি সহজ লোক না । আমাকে ভয় পাওয়ার দুই হাজার দুইটা কারণ আছে।