তা তো বটেই, তা তো বটেই।
রাত্রিকে আমি নিজের বোনের চেয়েও আপন জানি। সে আমার সঙ্গে কথা বলে না।
বাবা আবারও অসহায়ের মত তাকালেন আমার দিকে। পান্নাভাবী আরো শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। আমি বললাম, ভাবী, এখন আমাদের রওনা হতে হয়। পাঁচটার আগেই বাবাকে হাসপাতালে নিতে বলেছে।
আমি চাচাজানের সঙ্গে দুটা কথা বলব। চাচাজান শুনুন– আপনি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। মানুষের জীবন-মরণের কোন ঠিক নেই। কাজেই আপনাকে আমি সব কথা বলতে চাই –আমি রাত্রির সামনেই বলব –আমি কোন লুকোছাপা করব না। আমি লুকোছাপার মেয়ে না –আমি কাউকে কেয়ারও করি না। কেন কেয়ার করব? কার জন্যে কেয়ার করব– যে মেয়ের স্বামী থেকেও নেই সে কেন ..
পান্নাভাবীর কথা শেষ হবার আগেই নাজমুল ভাই চলে এলেন। পান্নাভাবী তাকে দেখে চুপ করে গেলেন। এরকম কখনো হয় না।
নাজমুল ভাই শান্ত গলায় বললেন –পান্না, তুমি ঘরে যাও।
পান্নাভাবী আপত্তি করলেন না। চোখ মুছে বের হয়ে গেলেন।
নাজমুল ভাই বললেন, আপনাদের হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্যে আমি গাড়ি রেখে দিয়েছি। চলুন দিয়ে আসি। পান্নার কোন কথাতেই আপনারা কিছু মনে করবেন না। ও পুরোপুরি অসুস্থ। চিকিৎসা শুরু হয়েছে। ডাক্তাররা চিকিৎসা করছেন।
বাবা কখনো কিছু জানতে চান না। এখনো জানতে চাইলেন না। নাজমুল ভাইয়ের গাড়িতে করেই আমরা হাসপাতালে গেলাম। নাজমুল ভাই বসলেন ড্রাইভারের পাশে। আমি বাবাকে নিয়ে পেছনের সীটে। আমি সারাক্ষণই বাবার হাত ধরে থাকলাম। এক সময় বললাম –ভয় লাগছে বাবা?
বাবা বললেন, হ্যাঁ।
বাবা তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে। মনে হচ্ছে খুব আগ্রহ নিয়ে তিনি জনস্রোত দেখছেন।
.
আমার ইচ্ছা ছিল বাবার সঙ্গে রাতে হাসপাতালে থাকব। বাবা কিছুতেই তা করতে দিলেন না। তিনি একা থাকবেন। বাবাকে ভর্তি করিয়ে নাজমুল ভাইয়ের গাড়িতে করেই আমি ফিরে আসছি। নাজমুল ভাই ফেরার সময়ও ড্রাইভারের পাশে বসতে যাচ্ছিলেন –আমি বললাম, আপনি পেছনে আসুন নাজমুল ভাই। গল্প করতে করতে যাই। নাজমুল ভাই পেছনে এসে বসলেন ঠিকই। কিন্তু কোন গল্প গুজবে গেলেন না। সারা পথ চুপ করে রইলেন। বাড়ির কাছাকাছি যখন এসেছি। তখন খুব নিচু গলায় বললেন –তোমার পান্নাভাবীর এখন ধারণা হয়েছে। হাসপাতালে তার একটি মেয়ে হয়েছিল। মেয়েটি চুরি হয়ে যায়। এই ঘটনা সবাই মিলে তার কাছ থেকে গোপন করেছে।
নাজমুল ভাই ছোট করে নিঃশ্বাস ফেললেন।
আমি বললাম, আপনি চিন্তা করবেন না নাজমুল ভাই। সমস্যা আসে, সমস্যা চলেও যায়। পান্নাভাবীর এই সমস্যা দূর হয় যাবে। কত ভাল চিকিৎসা এখন বের হয়েছে। আপনি ভাবীকে নিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যান।
নাজমুল ভাই ক্লান্ত গলায় বললেন –তাই করব। ডাক্তারও সে রকম সাজেস্ট করেছেন। আমি ওকে নিয়ে নেপাল যাচ্ছি।
খুব ভাল করছেন। আপনি আরেকটি কাজ করুন –আপনার সব বইপত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পুরো সময়টা ভাবীকে দিন। শরীরের অসুখের অসংখ্য চিকিৎসা আছে। মনের অসুখের একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে মমতা, ভালবাসা। আপনি ভালবেসে পান্নাভাবীর হাত ধরুন, দেখবেন তাঁর অর্ধেক অসুখ সেরে গেছে।
ওকে আমি কি পরিমাণ ভালবাসি তা তুমি জান না রাত্রি।
আপনি ঠিক বলেননি নাজমুল ভাই। আপনার ভালবাসা থাকলে আজ ভাবীর এই অবস্থা হত না।
নাজমুল ভাই তাকিয়ে আছেন। বিরক্ত চোখেই তাকিয়ে আছেন। আমি তার বিরক্তি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললাম– পান্নাভাবী আপনার সম্পর্কে কিছু নোংরা কথাও বলেন। সেই কথাগুলিও সত্যি বলেই আমার ধারণা।
নাজমুল ভাই শান্ত গলায় বললেন, গাড়িতে একজন ড্রাইভার আছে। আমি চুপ করে গেলাম।
পান্নাভাবীর কথাগুলি যে সত্য তা জোর গলায় বলার পেছনে আমার কারণ। আছে। উনার সঙ্গে প্রচণ্ড রাগারাগি হবার পর সেই রাতেই তিনি আমার কাছে একটা খাম পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই খামে রাণীর প্রেগনেন্সি রিপোর্ট, সঙ্গে ছোট্ট চিঠি –রাত্রি, রিপোর্টটা দেখ। পজেটিভ। শুরুতে তোমাকে অন্যকথা বলেছিলাম। তোমার নাজমুল ভাইকে ছোট করতে ইচ্ছা করছিল না বলেই। তোমার সঙ্গে রাগারাগির জন্যে আমি মোটেও দুঃখিত নই। দয়া করে তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে আসবে না। আমি কোন কথা বলতে আগ্রহী না।
.
বাসায় এসে দেখি বাবলু ফিরেছে। সে খুব উত্তেজিত। তার উত্তেজনার প্রধান কারণ ইস্তিয়াক প্ল্যান দিয়ে দিয়েছে। ডিআইটি এ্যালুভেলের জন্যে দেয়া এগারো কপি প্ল্যান। সেই সঙ্গে বাড়িটি তৈরি হবার পর কেমন দেখাবে সেই মডেল।
বাবলু বলল, কি অসাধারণ কাজ করেছে দেখেছিস আপা?
আমি বললাম, হ্যাঁ দেখলাম।
রাতদিন খেটে কাজটা করেছে। চলে যাবে তো — এই জন্যেই করা।
কোথায় যাবে?
কানাডায় চলে যাচ্ছে। হাইরাইজ বিল্ডিং টেকনিকে পি-এইচ. ডি করবে। আপা, মডেলটা দেখ– মডেলটা করতে ওর নিশ্চয়ই অনেক টাকা লেগেছে। এই টাকাটা ওকে দিয়ে দেয়া দরকার। তাই না?
হ্যাঁ।
কত টাকা লেগেছে মডেলে জেনে নেয়া দরকার। জিজ্ঞেস করা হয়নি।
আমি অবাক হয়ে বাবলুকে দেখছি। বাবাকে আমি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে এসেছি। এই সম্পর্কে সে কিছুই জানতে চাচ্ছে না। আশ্চর্য কাণ্ড! সে কাপড় পরছে –ইস্তিয়াকের কাছেই যাচ্ছে বোধহয়।
কোথায় যাচ্ছিস?
মডেলটা বীনুকে দেখিয়ে আনি। ও খুব খুশি হবে। ওর দারুণ আগ্রহ। ভাবছি ইস্তিয়াককে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। ও যেতে চাইবে কিনা কে জানে। ও সঙ্গে গেলে সুন্দর করে সব কিছু এক্সপ্লেইন করতে পারত। ভাল কথা আপা, তোর একটা চিঠি আছে। টেবিলে রেখে দিয়েছি –এক লোক এসে দিয়ে গেছে।