আমি চাপা গলায় বললাম, বাড়ির দক্ষিণে যে বকুল গাছ আছে সেই বকুলতলায় আমার মার করব আছে।
আপনার মা মাটির নিচে বাস করছেন না। তাঁর শরীর মাটিতে মিশে গেছে। তার পরেও বলছি –আপনার মার কবরের জায়গাটার উপর কোন স্ট্রাকচার উঠবে না। ডিজাইনে এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
ইস্তিয়াক এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে যেন এই মুহূর্তেই সে আমার কাছ থেকে হ্যাঁ বা না জাতীয় কিছু শুনতে চায়। তাও কি সম্ভব?
ইস্তিয়াক বলল, আপা, কিছু বলুন।
আমি বললাম, এই বাড়ি ভাঙা হবে না। আমার বা বাবার আপত্তির কথা তুমি বাদ দাও। বাবলুও কখনো এই বাড়ি ভাঙতে পারবে না। ধর, বাড়ি ভাঙার জন্যে মিস্ত্রী ডাকা হল। মিস্ত্রী যেই মুহূর্তে শাবলের একটা ঘা দেবে সেই মুহূর্তে বাবলু ছুটে এসে বলবে– না না, থাক থাক। যেমন আছে তেমন থাক।
আপনার এই ধারণার কারণ কি?
এই ধারণার মূল কারণ হল –মানুষ হিসেবে আমি এবং বাবা, আমরা দুজনই অনেক আধুনিক। বাবলু সেই তুলনায় অনাধুনিক ওর বয়স তো কম হয়নি –এই বয়সেও সে খুব কষ্ট পেলে কি করে জান? মার কবরের কাছে চলে যায়। বিড় বিড় করে মাকে তার কষ্টের কথা বলে। যে ছেলে এই কাজ করে সে কোন দিনই তার সারাজীবনের স্মৃতির বাড়ি ভাঙবে না।
ইস্তিয়াক বলল, আপা, আপনি যা বললেন তা ঠিক না। বাবলু সাহেবের মনে। নতুন বাড়ির ছবি ঝলমল করছে। তিনি এক ধরনের ঘোরের মধ্যে চলে এসেছেন। ঘোরের কারণেই বাড়ি ভাঙতে তিনি আপত্তি করবেন না। বাড়ি তৈরি হলে পর ঘোর কাটবে। তখন হয়ত মন খারাপ হবে। সেই মন-খারাপও সাময়িক ব্যাপার হবে। আপনি কি আমার সঙ্গে বাজি রাখবেন?
না, আমি বাজি রাখব না। বাজি রাখলেই হারব। আমি কখনো বাজি জিততে পারি না।
.
১১.
বাবাকে আজ চোখের হাসপাতালে ভর্তি করানো হবে। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি খানিকটা ভয় পেয়েছেন। সকালে ঘুম থেকে ওঠেই বললেন, অপারেশনটা না করালে হয় না? আমি তো তেমন প্রয়োজন দেখছি না। ভালই দেখি তো। ডাক্তাররা সব কিছু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে।
তোমার কি ভয় লাগছে বাবা?
নাহ।
ভয়ের কিছু নেই। চোখের ছানি কাটিয়ে অপারেশন কোন অপারেশন না।
তুই তো মা ডাক্তারের মত কথা বলছিস।
তোমার যদি খুব বেশি ভয় লাগে তাহলে আজ যেতে হবে না। আরেকদিন যাবে।
না না, আজই যাব।
বাবা গম্ভীর হয়ে বারান্দায় বসে রইলেন। তিনি যেমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসেন সেরকম বসা না –শক্ত হয়ে বসে থাকা। যেন মেহমান হিসেবে এসেছেন। আমি বললাম, বাবা, তোমাকে তো বিকেলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। তুমি সকাল থেকেই বারান্দায় এমন শক্ত হয়ে বসে আছ কেন? বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম কর।
শুতে ইচ্ছা করছে না। বসে থাকতে ভালই লাগছে।
বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে এই খবর আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা জেনে গেছেন। ঢাকায় আমাদের আত্মীয়-স্বজন তেমন নেই। যারা আছেন, তারা সবাই একবার করে দেখে ফেলেছেন। কেউ আবার কলা-টলাও নিয়ে আসছেন। একজন হরলিক্স নিয়ে এলেন।
আত্মীয়-স্বজন আমাদের বাড়িতে এলে আমার ভাল লাগে না। অবধারিতভাবে তারা আমার দুঃখময় জীবন নিয়ে আফসোস করেন। আফসোস করাটা তাঁরা দায়িত্ববোধের কারণেই করেন। কঠিন গলায় মামুনের কিছু সমালোচনা করা হয়। লোকটা পিশাচ না শয়তান এ নিয়ে গবেষণা হয়। কেউ কেউ আমাকে সান্তনা দেবার চেষ্টা করেন। আমার সান্ত্বনার প্রয়োজন নেই এই কথাটা কেউ বুঝতে চান না। এই ভাবে জীবন পার করা উচিত না — বিয়ে করা উচিত। যা ঘটেছে, ঘটেছে। এটা। নিয়ে বসে থাকলে তো হবে না।
আমার দূর সম্পর্কের এক চাচা আছেন যার কাজই হচ্ছে আমার বিয়ের জন্যে অদ্ভুত অদ্ভুত সব ছেলের খোঁজ আনা। একবার এক ছেলের খোঁজ আনলেন। সে অষ্ট্রেলিয়ায় থাকে। বেলজিয়ামের ছেলে। বাংলাদেশে অনেকদিন ছিল। ভাল বাংলা জানে। বাঙালী মেয়েদের তার খুব পছন্দ। সে একটা বাঙালী ডিভোর্সড মেয়ে বিয়ে করতে চায়।
আমি বললাম, ডিভোর্সড কেন? কুমারী মেয়ে বিয়ে করতে অসুবিধা কি?
অসুবিধা কি তা তো এত ডিটেল জানি না। তুই রাজি থাকলে তখন না হয় খোঁজ-খবর করব।
এই জাতীয় মানুষদের পছন্দ করার কোনই কারণ নেই। এদের অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবারও উপায় নেই। বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হবে এই খবরে যারা উদ্বিগ্ন হয়ে আসছেন সঙ্গত কারণেই হাসিমুখে তাদের সঙ্গে আমার কথা বলতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যতই দিন যাচ্ছে ততই আমি অভিনয় কলায় পারদর্শী হয়ে উঠছি। কি সুন্দর অভিনয় করে যাচ্ছি! যে আসছে তার সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলছি।
বিকেলে বাবাকে নিয়ে বেরুবার আগে আগে পান্নাভাবী এলেন। আমার সঙ্গে রাগারাগি হৈচৈ-এর পর এই প্রথম তিনি আমাদের বাড়িতে এলেন। বাবাকে পা ছুঁয়ে সালাম করে বললেন –চাচা, আপনি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন কেউ আমাকে এই খবর দেয়নি। আপনাদের বাসায় সকাল থেকে লোকজন আসছে কেন খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম। আমরা কি আপনার পর?
বাবা অপ্রস্তুত গলায় বললেন, না না, তোমরা পর হবে কেন মা?
আপনারা বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি বানাচ্ছেন। বাড়ি ভাঙলে আমরা যাব কোথায়? আমরা কিছুই জানি না। এদিকে বাড়ি ভাঙা হচ্ছে।
বাবা আমার দিকে তাকালেন। কি বলবেন বুঝতে পারছেন না।
পান্নাভাবীর চোখে পানি এসে গেল। তিনি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন –আমার বাবা নেই, আপনাকে বাবার মত দেখে এসেছি।