বীনু বলল, এত সুন্দর বাড়ি আপনারা ভেঙে ফেলবেন?
বাবলু বিরক্ত গলায় বলল, সুন্দরের তুমি কি দেখলে? অন্ধকার বাড়ি। আলো নেই, বাতাস নেই, চারদিকে ঘর।
আমার এরকম বাড়িই ভাল লাগে।
তোমার ভাল লাগলে তো হবে না। সবার ভাল লাগতে হবে। তুমি আবার কোথায় রওনা হলে?
আপার সঙ্গে দেখা করে আসি।
আপা তো পালিয়ে যাচ্ছে না। কাজের মাঝখানে চলে যাওয়া আমার খুবই অপছন্দ।
আচ্ছা যাচ্ছি না। এখন কি করতে হবে বলুন?
ইস্তিয়াক যাই বলবে তুমি তাই করবে। আমি এই ফাঁকে চট করে দোকান থেকে চা নিয়ে আসি। ইস্তিয়াকের আবার মিনিটে মিনিটে চা লাগে। আপাকে কতবার আর বলব?
আমি দেখলাম বাবলু ফ্লাস্ক নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে চলে যাচ্ছে। সে যে কি আনন্দে আছে তা দূর থেকেও আমি বুঝতে পারছি। ইস্তিয়াক ছেলেটির প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেল। এই ছেলে বাবলুর ভেতর স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছে। স্বপ্ন তৈরি করা সহজ ব্যাপার না। বড় লেখক, বড় কবি এবং মহাপুরুষরাই শুধু স্বপ্ন জাগাতে পারেন।
বীনু এতক্ষণ পর আমাকে দেখল। হাসল। আমি বললাম, কি খবর বীনু?
আপা, আপনি নাকি আমাকে খবর দিয়েছেন, খুব জরুরি?
আমি হাসলাম। বীনু সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল।
জরুরি খবরটা কি?
আমি আবারও হাসলাম। বীনু বলল, বাবলু ভাই যে মিথ্যেমিথ্যি আমাকে আসতে বলেছেন সেটা তখনি বুঝেছি।
বেশি বেশি বুঝা ভাল না বীনু। যারা বেশি বুঝে তাদের অনেক সমস্যা।
যারা কম বুঝে তাদের আরো অনেক বেশি সমস্যা।
আমার ভাইটাকে কি তোমার পছন্দ হয়েছে?
বীনু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাসল। প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বলল, ইস্তিয়াক সাহেব কি উনার বন্ধু?
এখন তো সেরকমই মনে হচ্ছে। তবে সম্পর্কটা ঠিক বন্ধুর মত না। অনেকটা গুরু-শিষ্যের মত। ইস্তিয়াককে সে পীরের মত দেখছে।
আমারও তাই মনে হয়েছে।
বাবলু চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে এসে আবার বের হয়ে গেছে। তার অতি ব্যস্ত ভঙ্গি। নিশ্বাস ফেলার সময়ও নেই এমন ভাব। আমি নিচে নেমে এলাম। আমারও দোকানের চা খেতে ইচ্ছা করছে। চা খেতে খেতে ইস্তিয়াকের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করা যাক। নিজের কাজকর্ম ফেলে ও যে ভাবে আমাদের এখানে পড়ে আছে দেখে মায়াই লাগে।
ইস্তিয়াকের খবর কি?
তেমন কোন খবর নেই আপা। মোটামুটি ড্রয়িং একটা পঁড়া করিয়েছি। এক সপ্তাহের মধ্যে ফাইনাল করে ফেলব।
কি রকম হচ্ছে ডিজাইন?
সহজ, কিন্তু সুন্দর। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে কেউ চোখ বড় বড় বলবে না — আরে, এটা কি? আবার বাড়িটার দিকে না তাকিয়ে কেউ চলে যাবে তাও হবে না।
জিনিসটা হবে কেমন?
একতলায় অর্ধেক হবে ফাঁকা। গাড়ির গ্যারেজ, বাকি অর্ধেকে বাবলু সাহেবের ভিডিও, স্টুডিও, কিছু দোকানপাট। দোতলা, তিনতলা, চারতলায় এ্যাপার্টমেন্ট। প্রতি দোতলায় দুটা করে মোট ছটা। ছাদটা হবে রিক্রিয়েশন স্পট।
সেখানে কি থাকবে?
একটা সুইমিং পুল থাকবে, ব্যাডমিন্টন কোর্ট এবং টেনিস কোর্ট থাকবে। হেথ ক্লাব থাকবে।
বল কি?
আরো আছে– বাচ্চাদের একটা সেকশন আছে
তুমি দেখি ভয়াবহ কাণ্ডকারখানা শুরু করেছ।
ভয়াবহ কিছু করছি না আপা। আমি যা করছি তা হল অসম্ভব সুন্দর একটা ডিজাইন দিয়ে যাচ্ছি। যদিও জানি আপনারা এই বাড়ি কখনোই ভাঙবেন না।
ইস্তিয়াকের কথায় আমি চমকালাম। আমার চমক ইস্তিয়াকের চোখ এড়াল না। সে সহজ গলায় বলল, আপনারা কেন এই বাড়ি ভাঙবেন না সেটাও আমি জানি। এই বাড়ি ঘিরে আপনাদের অনেক স্মৃতি। বাড়ি ভাঙা মানে স্মৃতি নষ্ট করে ফেলা। স্মৃতির ব্যাপারে মানুষ খুব স্পর্শকাতর। সে সবকিছু নষ্ট করতে রাজি, স্মৃতি নষ্ট করতে রাজি না। এ ছাড়া আছে সাহসের অভাব। অভ্যস্ত পরিবেশ থেকে নতুন পরিবেশে যেতে যে সাহস লাগে আমাদের সেই সাহস নেই বললেই হয়।
বীনু বলল, আপনি যখন নিশ্চিত এই বাড়ি ভাঙা হবে না তাহলে কষ্ট করে ডিজাইন করছেন কেন?
করছি, কারণ ডিজাইন শেষ করবার পর, ডিজাইন দেখিয়ে আমি আপনাদের বাড়ি ভাঙার ব্যাপারে প্রভাবিত করতে পারব ভেবেই করছি। আমার আত্মবিশ্বাস প্রবল।
আমি বললাম, তুমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে — দাঁড়িয়ে আছ। চা খাচ্ছ না।
ইস্তিয়াক বলল, আমি চা একেবারেই খাই না। বাবলু সাহেবকে এই কথা কয়েকবার বলেছি, তারপরেও কেন জানি উনার মাথায় ঢুকে গেছে আমি মিনিটে মিনিটে চা খাই। উনি চায়ের কাপ আমার হাতে দেন। আমি এক-দুচুমুক খেয়ে। ফেলে দেই। চা-টা যে আমি ফেলে দিচ্ছি সেটাও উনার চোখে পড়ছে না।
আমি বললাম, ইস্তিয়াক! তুমি আজ দুপুরে আমাদের সঙ্গে খাবে। তেমন কিছু না, আমরা যা খাই তাই খাবে। ডাল ভাত। ভাল কথা, বাবলু কি তোমার সঙ্গে বীনুর পরিচয় করিয়ে দিয়েছে?
না, পরিচয় করিয়ে দেননি। তবে উনার কথা শুনেছি।
কোথায় শুনেছ?
বাবলু সাহেব বলেছেন।
বীনু বিস্মিত হয়ে বলল, কি বলেছেন?
বলেছেন –বীনু মেয়েটার বিশ্রী কিছু অভ্যাস আছে। রাতের বেলা ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করা। রোজ রাতে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে। চুল শুকায় না –ঠাণ্ডা লেগে যায়। আপনি নাকি দুদিন পরে পরেই জ্বরজারি বাঁধিয়ে ফেলেন।
আমি তাকালাম বীনুর দিকে। সে খুব লজ্জা পাচ্ছে। আবার খুব আনন্দও পাচ্ছে। লজ্জা ও আনন্দে তার চোখ চকচক করছে।
ইস্তিয়াক আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপা, আপনি আমার একটা কথা মন দিয়ে শুনুন। বাড়ি ভেঙে ফেলুন। ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা আমি করে দেব। এর ফল শুভ হবে।