আমি কি করছি?
রাত দুটা-তিনটায় তোমার নাজমুল ভাইয়ের সঙ্গে গুজগুজ, ফুসফুস-এর অর্থ কি আমি জানি না? আমি ঠিকই জানি।
প্লীজ ভাবী, আপনি চুপ করুন। আপনি কি বলছেন আপনি নিজে বুঝতে পারছেন না?
আমি কচি খুকী। আমি এখনো বোতলে করে দুদু খাই। কাজেই আমি কিছু বুঝতে পারি না। আর তুমি সব বোঝ। সব জান। তুমি ভেবেছে কি? এত সহজে তোমাকে ছেড়ে দেব? হাটে হাড়ি ভেঙে দেব না? আমাকে এত সহজ মেয়ে মনে করবে না। তুমি আমার সংসার ভেঙেছ। আমিও তোমার সংসার ভাঙব।
ভাবী, আমার কোন সংসার নেই, কাজেই ভাঙার প্রশ্ন আসে না। তাছাড়া আপনার সংসার ভাঙেনি। ভাঙার কোন সম্ভাবনা নেই।
পান্নাভাবীর চোখ জ্বলছে। হাত-পা কাঁপছে। এ কী ভয়ংকর অবস্থা!
শোন রাত্রি, আমার সংসার ভাঙার জন্যে আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি– তুমি কোনদিন তোমার ছেলেকে কাছে পাবে না। কোনদিন না। কোনদিন না।
আমি পান্নাভাবীর কথায় রাগ করলাম না। সহজ গলায় বললাম– ছেলেকে কাছে না পেলে না পাব। আপনি দয়া করে শান্ত হোন।
পান্নাভাবী হাউমাউ করে কাঁদছেন। আমি নিচে চলে এলাম। পান্নাভাবীর পাশে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকার কোন অর্থ হয় না। বাবাকে নিয়ে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে। যেতে হবে। তার চোখে না-কি সমস্যা হচ্ছে। ভাল দেখতে পাচ্ছেন না। তার নিজের কোন অভিযোগ নেই। টিভি ছেড়ে তিনি টিভির সামনে বসে থাকেন। কিন্তু তার চোখ-মুখ দেখ মনে হয় তিনি কিছু দেখছেন না।
ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের ডাক্তার বললেন –আপনার চেখের অবস্থা খুবই খারাপ। আপনি তো কিছুই দেখছেন না। এতদিন আসেননি কেন?
বাবা বললেন, আমার তেমন অসুবিধা হচ্ছে না।
চোখে দেখচ্ছেন না আর আপনার অসুবিধা হচ্ছে না এসব আপনি কি বলছেন?
অনেক তো দেখলাম। আর কত? আমার কোন আফসোস নেই ডাক্তার সাহেব। আমি ভাল আছি। সুখেই আছি।
আপনিই খুবই অদ্ভুত কথা বলছেন– যাই হোক, সেটা আপনার ব্যাপার– আমার যা বলার বলি। আপনার বা চোখে এখনো কিছু দৃষ্টিশক্তি আছে। তবে ছানি পড়েছে। ছানি কেটে দিতে হবে। আপনি অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হবেন।
জি আচ্ছা, হব।
বাবাকে নিয়ে রিকশায় করে ফিরছি। বাবা ডান হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। ভাবটা এরকম যেন রিকশা থেকে ঝাঁকুনি খেয়ে পড়ে গেলে আমাকে রক্ষা করবেন।
খুকী?
জ্বি বাবা।
সুন্দর একটা সংসার শুরু করেছিলাম। সব একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। চোখ দিয়ে আমি কি করব বল? কি দেখব আমি?
সব আবার ঠিক হয়ে যাবে। বাবলুর বিয়ে হলেই সংসারের চাকা ঘুরে যাবে।
এই কথা কেন বলছিস?
আমার মন বলছে। বীনু মেয়েটার ভেতর সংসার সাজানোর ক্ষমতা আছে। ও যেখানে থাকবে সেখানেই আনন্দ তৈরি হবে।
তোর মধ্যেও তো সেই ক্ষমতা ছিল।
হ্যাঁ আমার মধ্যেও ছিল। ক্ষমতা কাজে লাগানোর ব্যাপার আছে। সবাই ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারে না। বীনু পারবে। কাজেই চোখ ঠিক করতে হবে। ওদের সাজানো সংসার তোমাকে দেখতে হবে না?
তা তো হবেই। খুকী!
জ্বি বাবা।
একটু পার্কের দিকে বেড়াতে যাবি? তোরা তো জানিস না তোর মার এই একটা শখ ছিল –আমাকে নিয়ে পার্কে ঘোরা। তোরা শুনলে হাসাহাসি করবি। এই জন্যে তোদের লুকিয়ে সে পার্কে যেত। গাছপালা তার এত পছন্দ ছিল!
চল পার্কে যাই। বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাবে?
চল যাই। আরেকটা কথা তোকে বলি খুকী– ডাক্তার আমার চোখ যত খারাপ বলছে আমার চোখ তত খারাপ না। রাতে দেখতে কষ্ট হয় কিন্তু দিনের বেলা আমি ভালই দেখি।
আমাকে দেখতে পাচ্ছ?
অবশ্যই পাচ্ছি।
বাবা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি সম্ভবত ডুব দিয়েছেন নিজের জগতে। সব মানুষকেই কখনো না কখনো নিজের জগতে ডুব দিতে হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই জগতে ডুবে থাকার সময় ক্রমেই বাড়তে থাকে। মৃত্যু বোধহয় পুরোপুরি ডুবে যাওয়া। বাবার এই নিজস্ব জগক্টা কেমন কে জানে! আজকাল আমার জানতে ইচ্ছে করে। খুব জানতে ইচ্ছে করে। বাবা গাঢ় স্বরে বললেন, ও খুকী!
কি বাবা?
তোকে নিয়ে ঘুরছি। খুব ভাল লাগছে রে মা।
ভাল লাগলে আজ সারাদিন বোটানিক্যাল গার্ডেনে বসে থাকব। আর পথে পথে হাঁটব।
বাবা এক হাতে চোখ মুছলেন। গভীর আনন্দে তার চোখে পানি এসেছে কি না বুঝতে পারছি না। আজকাল এম্নিতেই তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ে।
.
১০.
আমি দোতলার বারান্দা থেকে দেখলাম ইস্তিয়াক, বাবলু এবং বীনু গজফিতা নিয়ে টানাটনি করছে। মাঝ-উঠোনে একটা টেবিল বিছানো হয়েছে। সেই টেবিলে। পেপারওয়েটে চাপা দেয়া কিছু কাগজপত্র, একটা পেনসিল। ইস্তিয়াক মাঝে মাঝে টেবিলের কাছে যাচ্ছে –কি সব লিখছে আবার মাপামাপি হচ্ছে। শুরুতে শুধু ইস্তিয়াক এবং বাবলু ছিল। বীনু এসেছে কিছুক্ষণ আগে। সে দোতালায় উঠতে যাচ্ছিল, বাবলু ধমকের মত গলায় বলল, বীনু, ফিতার মাথাটা ধর তো।
আমি দোতলা থেকে বীনুর মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না, সে সম্ভবত হাসল, কারণ বাবলুর কঠিন গলা শুনলাম, হাসছ কেন? একটা কাজ করতে বলছি এর মধ্যে হাসির কি আছে? না-কি ফিতার মাথা ধরলে মানহানি হবে।
বীনুর গলা শুনলাম। সে বলল, মানহানি হবে না, দিন ধরছি।
বাবলু বলল, এ হচ্ছে ইস্তিয়াক। স্কলার ছেলে। ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছে। ডিজাইন বলে একটা ব্যাপার আছে, সেই ডিজাইনে রেকর্ড মার্ক পেয়েছে। ইস্তিয়াক আমার বাড়ির প্ল্যান করে দিচ্ছে। একটা পয়সা নিচ্ছে না।