বাবলু বিরক্ত হয়ে বলল, তুই ঠাট্টা করছিস? আমাকে তুই এত বোকা ভাবিস কেন? আমার কাজকর্ম, কথাবার্তা বোকার মত, বুদ্ধি বোকার মত না।
আমি হাসলাম। বাবলু বলল, শুধু শুধু হাসিস না –ভাল কথা, আমি বীনুকে বলেছি তুই তাকে এ বাড়িতে আসতে বলেছিস। তোর কি যেন জরুরী কথা।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কই, কখন বললাম?
আহা, আমি মিসটেক করে একটা কথার কথা বলে ফেলেছি, তুই তাই ধরে রেখেছিস কেন? মানুষ মিসটেক করে না?
বীনু কখন আসবে?।
অসুখ কমলেই আসবে। কে জানে অসুখ নিয়েই হয়ত আসবে। তুই জরুরী কথা বলার জন্যে ডেকেছিস এটা শুনেই সে অস্থির হয়েছে।
আমি হাসছি। আমার হাসি দেখে বাবলু খুব বিরক্ত হচ্ছে।
অস্বস্তিকর দৃশ্য
০৯.
ভোরবেলাটা অস্বস্তিকর এক দৃশ্য দিয়ে শুরু হয়েছে। আমাদের উঠোনে রাণী দাঁড়িয়ে কাঁদছে। পাশে তার ট্রাঙ্ক। পান্নাভাবী সবার সামনে তার ট্রাঙ্কের তালা খুলছেন। রাণীকে বিদেয় করে দেয়া হয়েছে। বিদায় মুহূর্তে তার বিছানা তার ট্রাংক তল্লাসি করা হচ্ছে। এই তল্লাসি করা হচ্ছে বেশ আয়োজন করে। পান্নাভাবীর বাড়ির কাজের ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের ড্রাইভার আছে। কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে বাবলু। একটু দূরে শুকনো মুখে নাজমুল ভাই দাঁড়িয়ে। তিনি বললেন –তল্লাসি আড়ালে করলে হত না?
পান্নাভাবী ফোঁস করে বললেন –চুরি আড়ালে করা হয়। তল্লাসি আড়ালে হয় না। তোমার বাড়তি মায়া কেন? তোমার খারাপ লাগলে চলে যাও। তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে কে বলেছে?
নাজমুল ভাই চলে যেতে ধরলেন। পান্নাভাবী বললেন, না, তুমি যাবে না। তুমি দাঁড়াও। নাজমুল ভাই দাঁড়িয়ে পড়লেন।
রাণীর বিছানায় কিছু পাওয়া গেল না। ট্রাঙ্ক খোলা হল। ট্রাঙ্কের এক কোণে রুমালে মোড়া পান্নাভাবীর সোনার বালা পাওয়া গেল। রাণী চেঁচিয়ে কাঁদতে শুরু করল। পান্নাভাবী বালাটার দিকে হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে আছেন।
বাবলু বলল, এমি এমি ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না ভাবী। পুলিশে হ্যান্ডঅভার করে দিতে হবে।
পান্নাভাবী কঠিন গলায় বললেন, তুই চুপ করে থাক। কি করতে হবে না করতে হবে আমি জানি। এই রাণী, মরাকান্না কাঁদবি না। খবর্দার।
রাণী কাঁদতে কাঁদতে বলল, আম্মা, আমি কিছুই জানি না।
তোকে কিছু জানতে হবে না। কাঁদতে হবে না। তুই চলে যা। তোকে যেন এ বাড়ির ত্রিসীমানায় না দেখি।
পান্না ভাবী তাকে এক মাসের বেতন দিয়ে দিলেন। রোজার ঈদের আগে একবার এসে জাকাতের শাড়ি নিয়ে যেতে বললেন। নাটকের অবসান ঘটিয়ে আমাকে বললেন, তোমার সঙ্গে কথা আছে –রাত্রি, আমার সঙ্গে একটু আস। ছাদে আস।
কথা শোনার জন্যে ছাদে যেতে হবে কেন? এইখানেই বলুন।
না, এখানে বলা যাবে না –জরুরী কথা। অসম্ভব জরুরী।
আমি বিরক্তমুখে পান্নাভাবীর অসম্ভব জরুরী কথা শোনার জন্যে ছাদে গেলাম। সকালের কড়া রোদে আমার কখনো ছাদে যেতে ইচ্ছা করে না। ছাদ হল রাতের জন্যে। সকালের জন্যে বারান্দা এবং দুপুরের জন্যে দরজা-জানালা বন্ধ ঘর।
আপনার জরুরী কথাটা কি পান্নাভাবী?
রাণীকে বিদেয় করে দিলাম।
সে তো দেখতেই পেলাম।
কোন একটা বড় অজুহাত না দিয়ে তো বিদায় করা যায় না –এই জন্যেই চুরির ব্যাপারটা নিয়ে এসেছি।
ও তাহলে চুরি করেনি?
না, হাতের বালাটা রুমালে ঢুকিয়ে আমি এর ট্রাঙ্কে রেখে দিয়েছিলাম। মেয়েটার স্বভাব-চরিত্র খারাপ হলেও চুরির অভ্যাস নেই।
ভাবী, এরকম একটা নোংরা কাজ কেন করলেন?
সেটাই তোমাকে বলার জন্যে এখানে নিয়ে এসেছি। তোমার ভাইকে শায়েস্তা করার জন্যে এটা করেছি। তোমার ভাইকে বলেছি রাণীর প্রেগনেন্সি টেস্ট পজিটিভ এসেছে। এবং আমি তোমার ভাইকেই সন্দেহ করছি। এতে হবে কি –সারাজীবন সে ভয়ে আধমরা থাকবে।
তাঁর দায়দায়িত্ব থাকলে তবেই ভয়ে আধমরা থাকবেন। তাঁর কোন দায়-দায়িত্ব নেই যখন তখন যা হবে –তিনি ক্রমেই আপনাকে অপছন্দ করতে থাকবেন।
তুমি এরকম আজেবাজে কথা বলবে না।
ভাবী, আমি কোন আজেবাজে কথা বলছি না। যা সত্যি সেটাই বলছি। একটা মানুষকে আপনি ক্রমেই দেয়ালের দিকে চেপে ধরছেন। এক সময় তার নিঃশ্বাস নেবার জায়গাও থাকবে না। তখন ভয়াবহ ব্যাপার হবে।
কি ভয়াবহ ব্যাপার হবে? সে আমাকে মেরে ফেলবে?
না, তা উনি করবেন না। মানুষের স্বভাব অতি বিচিত্র। এত কিছুর পরেও তিনি আপনাকে ভালবাসেন। সেই ভালবাসার কারণে আপনি বেঁচে যাবেন। সমস্যা হবে তাঁর। তিনি নিজে ভয়ংকর কিছু করে বসবেন। একদিন দেখবেন ফ্যানের সিলিং-এ ঝুলছেন, কিংবা ছাদ থেকে রাস্তায় লাফিয়ে পড়ে গেছেন।
পান্নাভাবী কঠিন গলায় বললেন, তোমার এত বুদ্ধি, তোমার এত বিবেচনা কিন্তু নিজের সংসারে এই বুদ্ধি-বিবেচনা কাজে লাগল না কেন? তোমাকে কেন গলাধাক্কা। দিয়ে বের করে দিল?
আমি অবাক হয়ে পান্নাভাবীর দিকে তাকিয়ে আছি। তাকে এখন দেখাচ্ছে ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মত। কুদ্ধ বাঘিনী কেমন দেখতে আমি জানি না কিন্তু পান্নাভাবীর রাগে টকটকে লাল হওয়া মুখ আর বড় বড় চোখের দিকে তাকিয়ে বাঘিনীর কথাই মনে পড়ল।
রাত্রি শোন –তোমাকে আমি ছোটবোনের মত দেখি –তোমাকে স্নেহ করি। সেই জন্যেই এতদিন কিছু বলিনি –কিন্তু তলে তলে তুমি কি করছ তা-কি আমি জানি না? ভাল করেই জানি।