মানুষের ক্ষমতার কতটুকুই বা আমরা জানি? একবার খোঁজ নিয়ে আসতে তো দোষের কিছু নেই।
রাত নটার দিকে অস্থির হয়ে পড়লাম। বাবলু আজ বাড়িতেই আছে। ওকে সঙ্গে নিয়ে মামুনের বাড়িতে উপস্থিত হওয়া যায় না। ওকে কিছু বলতে লজ্জা লাগছে। রাত নটা এমন কিছু রাত না। আমি একাই যেতে পারি, যেতে কতক্ষণ আর লাগবে? সত্যি সত্যি মামুনদের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। মামুনের ইদানিং অনেক টাকাপয়সা হয়েছে– কিন্তু সে বাড়ি রেখেছে আগের মতই। সেই পুরানো গেট। পুরানো দেয়াল। শুধু দারোয়ান নতুন। সে আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইল। তাকানোর ধরন থেকেই বলা যাচ্ছে নানান ধরনের প্রশ্ন করে সে আমাকে বিরক্ত করবে। আমি তাকে সে সুযোগ না দেয়ার জন্যেই বললাম –মামুন কি আছে?
দারোয়ান হকচকিয়ে গিয়ে বলল, জি স্যার আছেন। যান, চলে যান।
এ বাড়িতে আজ বোধহয় কোন পার্টি। অনেক গাড়ি –অনেক লোকজন। ড্রয়িং রুমে জায়গা না হওয়ায় অনেকে বসেছে বারান্দায় বেতের চেয়ারে। তপতী মেয়েটি বারান্দায় বসে কার সঙ্গে যেন গল্প করছে। মেয়েটা তো ভারী সুন্দর। সাদা শাড়িতে স্বরস্বতী প্রতিমার মত দেখাচ্ছে। রূপবতীদের ধবধবে সাদা শাড়িতে খুব মানায়। কিন্তু রূপবতীরা কেন জানি সাদা রং পছন্দ করে না। আমি কি করব? চলে যাব না সিঁড়ি বারান্দায় হতচকিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকব?
রাত্রি, তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? এসো।
মামুন নিজেই আমাকে এগিয়ে নিতে এলো। এরকম ভঙ্গি করল যেন আমি নিমন্ত্রিত অতিথিদের একজন। আসতে দেরি করেছি।
কোন পার্টি না-কি?
হু। আজ ফ্যাক্টরি স্টার্ট হল সেই উপলক্ষে পার্টি। তুমি ভাল দিনে এসেছ। এসো, ভেতরে এসো।
তোমার পার্টির রসভঙ্গ করতে চাই না। টুকুন কি তোমার কাছে?
না। ওর আসার কথা, আসেনি। এই মাসেই এসে যাবে। এলেই খবর পাবে। শুধু টুকুনের খোঁজ নিতেই এসেছ?
হু। এখন যাই।
একটু বসে যাও।
না।
চল তোমাকে গাড়ির ব্যবস্থা করে দেই, পৌঁছে দেবে।
গাড়ি লাগবে না।
মামুন হেসে ফেলে বলল, আমি তোমার বন্ধু না হতে পারি, শত্রু না। তুমি শত্রুর মত আমাকে দেখছ কেন? ড্রাইভার যাবে, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। ঢাকা শহরের যা অবস্থা –একা একা রাতে রিকশায় চলাই মুশকিল। তুমি একা এসেছ?
আমি জবাব দিলাম না। এত মন খারাপ লাগছে –আমি ধরেই নিয়েছিলাম টুকুনকে পাওয়া যাবে। দেখা হলে প্রথম কোন কথাটা বলব তাও ভেবে এসেছি — কেমন আছেন গো বড় ব্যাটা টুকুন সোনা? এই বাক্যটির বিশেষ মাহাত্ম আছে। চির গম্ভীর টুকুনের গাম্ভীর্য এই বাক্যটিতে কেন জানি ভেঙে যেত। সে ফিক করে হেসে ফেলতো। হেসে ফেলেই বুঝতো, হাসা ঠিক হয়নি। সে গম্ভীর হবার চেষ্টা করে আরো বেশি হেসে ফেলতো।
.
বাসায় ফিরে দেখি –বাবলু চিন্তিত মুখে বাইরে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। সে আমাকে দেখেই হুংকার দিয়ে উঠল –কাউকে কিছু না বলে কোথায় গিয়েছিলি? আমরা চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। বাবা এর মধ্যে একশবার দোতলা একতলা করেছেন। গিয়েছিলি কোথায়?
কোথাও না –রিকশা করে রাস্তায় ঘুরেছি।
কেন?
এম্নি ঘুরলাম। ভাত খেয়েছিস?
না। তোর কোন খোঁজ নেই –আমি চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। এর মধ্যে ভাতও খেয়ে ফেলব? তুই ভাবিস কি আমাকে?
আয় ভাত খেয়ে নেই। খিদে লেগেছে।
বাবা বললেন, রাতে কিছু খাবেন না। শুধু এক গ্লাস লেবুর শরবত খাবেন। আমি কোথায় গিয়েছিলাম –কেন গিয়েছিলাম কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। আমি যে ফিরে এসেছি এই আনন্দেই তিনি অভিভূত।
.
খেতে বসে বাবলু হড়বড় করে নানান কথা বলতে লাগল। বুঝলি আপা, ইস্তিয়াককে তো দেখেছিস স্কলার ছেলে। ছোট-খাট দেখতে কিন্তু ধানী মরিচ। রেকর্ড মার্ক পেয়ে বেড়াছেঁড়া অবস্থা। স্কলারশীপ পাওয়ার সম্ভাবনা। পেলেই বিদেশ চলে যাবে। স্কলার ছেলে তো দেশে থাকে না। আমার কাজটা বিনা পয়সায়। করে দেবে।
বিনা পয়সায় তুই-ই-বা কেন একটা লোককে দিয়ে কাজ করাবি?
টাকা নিতে না চাইলে আমি কি করব? আমি তো দিতেই চাই।
তুই তাহলে সত্যি সত্যি মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং বানাচ্ছিস?
অবশ্যই বানাচ্ছি। দুটা এ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করব। ব্যাংক লোন নেব। ব্যাংক লোনের ব্যবস্থাও ইস্তিয়াক করবে –ওর এক মামা হলেন অগ্রণী ব্যাংকের এম. ডি।
তুই তো দেখি মাছের তেলে মাছ ভেজে ফেলেছিস।
বাবলু আনন্দে হেসে ফেলল। অনেকদিন পর আজ এই প্রথম খাওয়া নিয়ে হৈ চৈ করল না।
আপা!
কি?
বাবলু ইতস্তত করে বলল, আজ বিকেলে বীনুদের বাড়ি গিয়েছিলাম। ওদের বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ মনে হল, ঐদিন ছোট মেয়েটা মাথায় ব্যথা পেয়েছে –খোঁজ নিয়ে যাই। নয়ত আবার ভাবতে পারে –কেমন মানুষ, খোঁজ নিল না!
খোঁজ নিয়েছিস?
হু।
আছে কেমন?
ভালই আছে –তবে বীনুর জ্বর। ওর নাকি রাতে শোবার আগে গোসল করার অভ্যাস। গোসল করতে গিয়ে ঠাণ্ডা লাগিয়েছে। চুল লম্বা তো –গোসল করে ভেজা চুল শুকায় না।
তুই কি চুল মেপে এসেছিস?
মাপতে হবে কেন? লম্বা চুল দেখে বোঝা যায় না?
কি কথা হল বীনুর সঙ্গে?
কথা আর কি হবে? আমি যাই বলি এই মেয়ে শুধু মুখ অন্যদিকে নিয়ে হাসে। দেশের পলিটিকস নিয়ে একটা সিরিয়াস কথা বলেছি, সেটা শুনেও হেসে ফেলেছে।
তোর সিরিয়াস কথা না বলাই ভাল। সবার মুখে সিরিয়াস কথা মানায় না।