মামুনকে দেখলে মনে হবে সে খুব আপনভোলা স্বভাবের একজন মানুষ। মনে। হবে কিছুই বোধহয় সে লক্ষ্য করছে না –আসলে সে সবই লক্ষ্য করছে। খুব সাবধানী, খুব হিসেবী একজন মানুষ। বিয়ের পর পর একদিন সকালে নাশতা খেতে বসেছে। সিগারেট চাইল –আমি সিগারেটের প্যাকেট এনে দিলাম। সিগারেট ধরিয়েই সে ভুরু কুঁচকে বলল, চারটা সিগারেট থাকার কথা। তিনটা কেন?
আমি বললাম, তোমার সিগারেট কে নেবে? তিনটাই ছিল।
অসম্ভব। রাত এগারোটার সময় দেখেছি –ছটা সিগারেট। শুতে যাবার আগে একটা খেলাম, রইল পঁচ। ভোরবেলা বেড-টির সঙ্গে একটা খেয়েছি –রইল চার। এখন দেখি তিনটা। কারণ কি?
আমি হাসতে হাসতে বললাম –তুমি হিসাব-নিকাশ বন্ধ কর তো। তুচ্ছ একটা সিগারেট!
মোটেই তুচ্ছ না। কোথায় গেল বের করতে হবে।
কে তোমার সিগারেট নেবে বল? দুটা কাজের মেয়ে ছাড়া এখানে কেউ আসেনি।
ওরাই নিয়েছে।
ওরা সিগারেট দিয়ে কি করবে?
খাবে। তুমি জান না লোয়ার লেভেলে স্মোকিং হ্যাবিট খুবই প্রবল। তুমি কাজের মেয়ে দুটাকে ডাক। জেরা করব।
আমি অবাক হয়ে বললাম, এটা কোন কথা হল? সামান্য একটা সিগারেটের জন্যে তুমি বাসায় কোর্ট বসাবে?
অবশ্যই বসাব। ব্যাপারটা তুমি যত সামান্য ভাবছ, আমি ভাবছি না। You start by Killing a cat, you end up by Killing a man. ডাক দু’জনকে।
আমার সামনে তুমি এটা করতে পারবে না।
বেশ, আমি আড়ালেই করব। তুমি শুধু ডেকে দাও।
আমি দু’জনকে ডেকে চায়ের কাপ হাতে ওদের বাড়ির ছাদে উঠে গেলাম। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে এত অস্বাভাবিক লাগছিল! মামুন দশ মিনিটের মাথায় ছাদে উঠে এসে হাসিমুখে বলল, চুরনি ধরা পড়েছে। মতির মা স্বীকার করেছে।
কি বলেছে?
ও সুন্দর একটা গল্প সাজিয়েছে। ঘর ঝাট দিতে গিয়ে সে দেখল সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট মোঝেতে কি করে যেন পড়ে গেছে। মাটিতে পড়ে থাকা সিগারেট আমি আর খাব না ভেবে সে সিগারেটটা তার ট্রাংকে রেখে দিয়েছে। দেশে যখন যাবে তখন মতির বাবাকে দেবে।
এই গুরুতর অপরাধের জন্যে তুমি তাকে কি শাস্তি দিয়েছ? মেরেছ?
না। ওকে এক মাসের বেতন, দেশে যাবার গাড়িভাড়া এবং একটা সিগারেট কেনার পয়সা দিয়ে বলেছি পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে।
তুমি সত্যি এটা করেছ?
অবশ্যই। তুমি পাঁচ মিনিট পর নিচে নামলে মতির মা’কে দেখবে না। রাত্রি, তুমি এরকম অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন?
অবাক হয়েছি, এই জন্যেই অবাক হয়ে তাকাচ্ছি।
অল্পতে অবাক হয়ো না। বী প্র্যাকটিক্যাল।
আমি প্র্যাকটিক্যাল ম্যান হতে পারিনি। চেষ্টাও করিনি। তিন বছর একজন প্র্যাকটিক্যাল মানুষের সঙ্গে বসবাস করেছি। এবং এক সময় মনে হয়েছে –পারছি না। আর পারছি না। টুকুনের বয়স তখন দেড় বছর। সে আমাদের সঙ্গে ঘুমোয় না। আলাদা ঘরে বেবীখাটের উপর ঘুমায়। রাতে তাকে দেখাশোনা করে একজন ট্রেইন্ড আয়া।
আমাদের সঙ্গে ঘুমুলে সে বার বার জাগে, কাঁদে। বিছানা ভিজিয়ে দেয়। মামুনের ঘুমের অসুবিধা হয়। তার দরকার পুরো রাতের ঘুম। সে ঘুম নষ্ট করতে রাজি না।
এক রাতে সে টুকুনের কান্নায় বিরক্ত হয়ে বলল, আমার এক রাতের অনিদ্রার অর্থ জান? এক রাতের অনিদ্রা মানেই দিনের কাজকর্ম ভণ্ডুল। এই অবস্থায় দিনে কাজকর্ম ভণ্ডুল করতে দেয়া যায় না। আমার মাথাটা এখন থাকবে ভাদ্র মাসের দিঘির পানির মত। ঢেউ থাকবে না। ঘূর্ণি থাকবে না। বুঝতে পারছ?
পারছি।
মুখে পারছি বলেলও তুমি আসলে পারছ না। আমাকে হৃদয়হীন মানুষ বলে মনে করছ। ব্যাপার সে রকম না। আমি একটা ইন্ডাস্ট্রি শুরু করছি। বাপ-দাদার জমানো সব টাকা সেখানে ঢেলেছি। ব্যাংকের কাছে আমার পোন কত জান? দুই কোটি পঁচিশ লক্ষ টাকা। আমার দায়িত্ব বুঝতে পারছ? হয় আমি আকাশ ফুড়ে ওঠে যাব –নয় পাতালে প্রবেশ করব। কাজেই এত সাবধানতা। তুমি এই সময়ে কোন কিছু নিয়ে আমাকে বিরক্ত করবে না। এমন কিছু করবে না যাতে আমি আমি …
বিরক্ত হও।
বিরক্তির কথা আগেই বলেছি, অন্য একটা টার্ম খুঁজছি।
রাগ?
হ্যাঁ রাগ। অবশ্যি রাগ আমি কখনো হই না। আমার লিমিট হচ্ছে বিরক্তি পর্যন্ত। আমার ব্যাপারে তোমার ভেতর যদি কোন খটকা তৈরি হয় সেই খটকা দূর করার জন্যও ব্যস্ত হবার দরকার নেই। যথাসময়ে খটকা দূর হবে। দয়া করে তিনটা বছর যেতে দাও, আমি ব্যবসা দাঁড় করিয়ে ফেলি …।
ওর সম্পর্কে নানান ধরনের খটকা আমার মধ্যে তৈরি হতে লাগল। যেমন– নানান কাজে ছ’দিন-সাতদিনের জন্যে তাকে বাইরে যেতে হয়। তার সঙ্গি থাকে তার অফিসের এক মহিলা টাইপিস্ট। বেঁটেখাট, কালো একজন মহিলা — পুরুষদের মত গলা। দেশের বাইরে এত কি টাইপ করার কাজ থাকে যে একজন টাইপিস্ট নিয়ে যেতে হয়? অবশ্যি কুরূপা একজন বয়স্কা মহিলা –অন্য কিছু ভাববার। অবকাশও নেই। তবু একবার রাতে খাবার সময় জিজ্ঞেস করলাম, তুমি বাইরে কোথাও যেতে হলেই টাইপিস্ট নিয়ে যাও কেন? টাইপের কাজ এত কি বল তো?
মামুন খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকাল। তার ভুরু কুঁচকে গেল। অর্থাৎ সে বিরক্ত হচ্ছে।
তুমি কি সত্যি সত্যি জানতে চাও?
হ্যাঁ।
জানতে চাচ্ছ যখন বলি– উত্তরটা পছন্দের হবে না, তারপরেও বলি এবং ঝামেলা শেষ করে রাখি। নয়ত বার বার তুমি এই প্রসঙ্গ তুলবে, ঝামেলার সৃষ্টি করবে। শুরুতেই আমাদের মধ্যে এক ধরনের বোঝাঁপড়া হয়ে যাওয়া ভাল। তুমি তোমার সীমা জানবে, আমি আমার সীমা জানব। বুঝতে পারছ?