আমি কাপে লবণ ভরতে ভরতে বললাম, তোদের বুঝি লবণ শেষ হয়ে গেছে? রাণী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাসল।
হাসছিস কেন?
আমার ঘরে লবণ আছে।
লবণ আছে তাহলে নিচ্ছিস কেন?
আমি ক্যামনে বলব আফা? আমরার আম্মার মাথার ঠিক-ঠিকানা নাই –কি করে কি না করে …।
রাণী আবার মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে হাসছে। তার বেগম সাহেবের মাথার ঠিক ঠিকানা না থাকায় সে মনে হয় খুব মজা পাচ্ছে।
গত দুই দিন ধইরা সাহেবরে কি সব কথা বলতাছে না তুললে বিশ্বাস হইব না। বুঝছেন আফা, লজ্জায় আমি মইরা যাই –এমন অবস্থা। আমারে লইয়া কথা। ছিঃ ছিঃ কি শরম!
রাণী, তুমি এখন যাও — আমি কাজ করছি।
পরে এক সময় আইয়া আফনেরে সব বিত্তান্ত বলব।
আমাকে কিছু বলতে হবে না।
আফনেরে একবার যাইতে বলছে। আফনের লগে আম্মার জরুরী কথা আছে।
আমি যাব একসময়। তুমি এখন ওঠ।
বাবলু পানির জগ নিয়ে বারান্দায় বসেছে। বাবার সঙ্গে খুব চেঁচামেচি শুরু করেছে। সে একাই চেঁচাচ্ছে, বাবা শুধু শুনে যাচ্ছেন। চেঁচামেচির বিষয়বস্তু হচ্ছে –কেন বাড়ি বিক্রি হবে না? কি আছে এই ভাঙা বাড়িতে? বাবা একবার শুধু বললেন, সকালবেলা কেন চেঁচাচ্ছিস?
বাবলু রীতিমত হুংকার দিল, এমন কোন আইন আছে যে সকালে চেঁচানো যাবে না? বলুন আইনের কোন ধারায় আছে পেনাল কোডের কোথায় লেখা আছে?
আচ্ছা, ওর কি মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে? ও এরকম করছে কেন? বাবার উচিত চুপচাপ বসে থেকে কিছু একটা করা।
এক পয়সা কেপিট্যাল নাই যে ব্যবসা করব। মাত্র তিন লাখ টাকা হলে ভিডিও-র দোকান দিতে পারি। চালু একটা ভিডিও দোকান থাকলে –আর কি লাগে? কিছুই লাগে না। কাকে আমি এটা বুঝাব? আমার কথার কি কোন দাম আছে? কোন দাম নেই।
বাবা বললেন, চুপ কর।
আমি চুপ করব কেন? আপনি চুপ করেন। এখন আর আপনার কথামত সংসার চলবে না। এখন এখন …
সকালবেলা এইসব কি শুরু করলি …?
আমি কিছুই শুরু করিনি। আপনি শুরু করেছেন। আমি বসে বসে ভেরেন্ডা ফ্রাই করব? আমার একটা লাইফ নেই? আমি আপনার কোন কথা শুনতে চাই না—- আজ এগারোটার সময় লোক আসবে –আপনি তাদের সঙ্গে কথা বলবেন … অবশ্যই বলবেন। যদি না বলেন … ।
না বললে কি করবি? তুই মারবি না-কি আমাকে?
আমি বারান্দায় এসে বললাম, বাবলু, নাশতা খেতে আয়। বাবলু খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রান্নাঘরে ঢুকল। তাকে দেখে কে বলবে যে কিছুক্ষণ আগেই হৈ চৈ করে এসেছে? চুলার আগুনের উপর হাত মেলে দিয়ে খুশি গলায় বলল –শালার শীত কাকে বলে দেখলি? নাশতা এখানেই দে। আগুনের পাশে বসে নাশতা খেয়ে ফেলি। তোর সাথে আমার আর্জেন্ট কথা আছে। নাশতা খেতে খেতে কথা সারি।
তোর সঙ্গে আমার কোন কথা নেই।
তোর কথা নেই। কিন্তু আমার আছে …। বাবা আমার কথা শুনতে চাচ্ছে না, তোকে শুনতে হবে। মোট বার কাঠার উপরে আমাদের এই ভাঙা বাড়ি। আমরা দেড়তলা নিয়ে থাকি –অর্ধেকটা ভাড়া দেই। সেই ভাড়ায় সংসার চলছে। কি ভাবে চলছে? গরুর গাড়ির মত –টুকুর টুকুর। টুকুর টুকুর। অথচ এখন ঢাকা শহরের এরকম একটা জায়গায় বার কাঠা জমি হল গোল্ডমাইন। স্বর্ণখনি … তুই আমার কথা শুনছিস তো?
শুনছি।
বাড়িটা বিক্রি করে দিলে যে টাকা পাওয়া যাবে সেটা শুনলে তোর হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে যাবে। সেই টাকায় গুলশান এলাকায় বাড়ি ভাড়া করে আমরা পায়ের উপর পা তুলে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারি।
তুই তোর ভিডিও-র দোকানটাও দিতে পারিস।
অবশ্যই পারি। ভিডিও-র দোকান বলে হেলা করিস না। আমি যা করতে যাচ্ছি তা হল –ফুল ভিডিও ইউনিট। রেন্টাল সেকশান তো থাকবেই। রেন্টাল সেকশানের বাইরে থাকবে ভিডিও ইউনিট প্লাস স্টুডিও … তুই তো আমার কথা শুনছিস না?
শুনছি।
শুনলে কিছু বলছিস না কেন?
তোর কথা বলার কথা। আমার বলার কথা না।
হ্যাঁ, দ্যাটস রাইট। টোটাল পরিকল্পনা করা আছে। অনেকের সঙ্গে কথাও বলেছি। একজন তার একটা পুরো ভিডিও ইউনিট বিক্রি করে দিচ্ছে পানির দামে।
তোর ভিডিও ইউনিটে কত টাকা লাগবে?
শুরুতে লাগবে লাখ দশেক। কিছু রানিং কপিটেল লাগবে। কর্মচারীদের বেতন। দোকান ভাড়া …।
আমি তোকে দশলাখ টাকা দেব। বাড়ি বিক্রি হবে না।
বাবলু চোখ বড় বড় করে বলল –দশ লাখ টাকা তুই আমাকে দিবি?
হ্যাঁ।
পাবি কোথায়?
কোথায় পাব সেটা দিয়ে তো তোর দরকার নেই। তোর পেলেই হল। তবে একটা কঠিন শর্ত আছে।
কি শর্ত?
বাড়ি বিক্রির নামও মুখে আনবি না।
কেন?
এই বাড়িতে আমরা ছোট থেকে বড় হয়েছি। বকুল গাছের নিচে মার কবর আছে। দাদাজানের কবর আছে। এর উপর দশতলা বিল্ডিং হবে?
বাবলু চিন্তিত মুখে সিগারেট ধরিয়েছে। আমি বললাম, আরেক কাপ চা দেব?
দে? তোর কাছে সত্যি দশলাখ টাকা আছে?
হু।
পেয়েছিস কোথায়? মামুন সাহেব দিয়েছে?
সেটা জানা তো জরুরী না। জরুরী হল –টাকাটা তুই পাবি কি পাবি না।
আমি পাব?
হ্যাঁ।
কখন পাব?
তুই খোঁজ-খবর করতে থাক। আজই তো আর তোর দশ লাখ টাকার দরকার নেই?
না, আজ দরকার নেই।
এত বড় একটা ব্যবসায় নামছিস, ভালমত খোঁজ খবর করবি না? এক লোক পানির দামে তার ভিডিও ইউনিট বিক্রি করে দিতে চাচ্ছে। কেন চাচ্ছে? সেটা দেখার দরকার না? হয়ত ঐ যন্ত্রটাই নষ্ট। ছবি উল্টা আসে।
বাবলুর ভুরু কুঁচকে আছে। সে গভীর চিন্তায় পড়েছে। আমি বললাম, খোঁজ খবর কর। ঘোরাঘুরি করতে খরচ আছে –আমি সেই খরচ দিয়ে দিচ্ছি। ঐটা দশলাখ টাকা থেকে কাটা যাবে। তবে যেহেতু এটা ক্যাপিটেল থেকে দিচ্ছি সেহেতু প্রতিটি পাই-পয়সার হিসাব খাতায় লিখে রাখবি।