সেদিন সন্ধ্যাতেই হঠাৎ মার শরীর খারাপ হল। শরীর খারাপ হলে তিনি কাউকে কিছু বলেন না। সেদিনও বললেন না। নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে রইলেন। শুয়ে থাকতেও তার বোধহয় ভাল লাগল না। তিনি সেখান থেকে উঠে এসে। বারান্দায় মেঝেতে বসলেন। আমি বললাম, তুমি ঠাণ্ডা মেঝেতে বসে আছ কেন মা? মা হাসিমুখে বললেন, এম্নি। খুকি, তুই বাবলুকে বল তো একটু আসতে।
আমি বললাম, ওকে ডেকে দিচ্ছি। কিন্তু তুমি আমাকে খুকি ডাকা কবে বন্ধ করবে?
আচ্ছা যা, আর ডাকব না।
আমি বাবলুকে খবর দিতে গেলাম। সে বিরক্ত মুখে বলল, কি জন্যে ডাকছে? উপদেশ দিতে চায়? আমার উপদেশ লাগবে না। এডভাইস আমি হেইট করি।
সে বছরই বাবলু দ্বিতীয়বারের মত আই. এ. ফেল করেছে। ফেল করায় খুব মেজাজ হয়েছে। কেউ ডাকলেই সে ভাবে উপদেশ দেবার জন্যে ডাকা হচ্ছে। বাবলু এল না। গটগট করে মার সামনে দিয়েই বের হয়ে গেল। মা ডাকলেন, এই শোন। বাবলু থমথমে গলায় বলল, আমার কাজ আছে। মা হাসতে লাগলেন, যেন তার কনিষ্ঠ পুত্রের ব্যবহারে তিনি খুব মজা পাচ্ছেন। আমাকে বললেন, ফেল করার পর মনে হয় বাবলুর কাজের চাপ খুব বেড়েছে।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, তুমি হেসে হেসে ওর এই সর্বনাশ করেছ। কখনো রাগ করো না, কখনো ধমক দাও না, তোমার ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা ফেল করবে না তো কি?
মা বললেন, খুকি, তোর বাবা কোথায় জানিস?
না।
অফিস থেকে ফিরতে তো দেরি করে না। আজ এত দেরি করছে কেন?
খুব বেশি দেরি হয়নি মা। পাঁচটার সময় অফিস ছুটি হয়– এখন বাজছে মাত্র ছটা। বাবার দেরি দেখে তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
না, ভয় পাচ্ছি না।
ঠাণ্ডার মধ্যে মেঝেতে বসে থাকবে না মা, তোমাকে দেখে আমারই ঠাণ্ডা লাগছে –ঘরে গিয়ে খাটের উপর বোস।
ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না। তুই বরং একটা কম্বল এনে বিছিয়ে দে, আমি কম্বলের উপর শুয়ে থাকি।
সন্ধ্যাবেলা কম্বলের উপর শুয়ে থাকবে কেন? তোমার কি শরীর খারাপ?
না, আমার শরীর খারাপ না। শরীর ভালই আছে।
আমি একটা কম্বল এনে ভাজ করে বিছিয়ে দিলাম। মা কম্বলে উঠে এলেন।
বালিশ দেব মা?
না, বালিশ লাগবে না। খুকি, তুই কি তোর বাবার অফিসে একটা টেলিফোন করে দেখবি দেরি হচ্ছে কেন?
ঠিক করে বল তো মা, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?
মা আবারো হাসলেন। মাথা নেড়ে বললেন, শরীর ভালই আছে।
আমাদের টেলিফোন নেই, পান্না ভাবীদের আছে। আমি দোতলায় টেলিফোন করতে গেলাম –এই ফাঁকে খালি বাড়িতে মা মারা গেলেন। টেলিফোন শেষ করে ফিরে এসে দেখি তিনি কাত হয়ে শুয়ে আছেন। তার ঠোঁটের কোণায় হাসি। সারাজীবন তার হাসিমুখ দেখেছি। মৃত্যুর সময়ও হাসিমুখ দেখলাম।
.
কলঘর থেকে বের হয়েই মনে হল –কি আশ্চর্য! আজ তো বাবা-মার ম্যারেজ ডে। আজ পৌষ মাসের ছ তারিখ। ভোররাতে উঠে বাবা যে ঘর ধুয়ে ঝকঝকে করে ফেলেছেন –এই হল তার রহস্য। মা নোংরা দেখতে পারতেন না। বিশেষ বিশেষ দিন মার এই স্বভাবের কথা বাবার হয়ত মনে পড়ে। তার ঘর পরিষ্কারের বাতিক মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।
রান্নাঘরে ঢুকতে যাচ্ছি বাবা ডেকে বললেন, আমার জন্যে নাশতা বানাবি না।
কেন?
শরীরটা ভাল লাগছে না। ভাবছি, রোজা রেখে ফেলব।
শরীর ঠিক রাখার রোজা? শেষ রাতে কিছু খাও নি …।
উপবাস একটা বয়সে খুব কাজে লাগে। আমার এখন যাচ্ছে –উপবাসের বয়স।
হুটহাট করে রোজা রাখার এই ব্যাপারটা বাবার ইদানিংকালের। প্রায়ই এরকম হয় –নাশতা নিয়ে গেছি, বাবা বলেছেন– আজ কিছু খাবনা রে মা। ভাবছি, রোজা রেখে ফেলব।
তবে আজকের রোজার অন্য অর্থ আছে। বিশেষ দিন সামনে রেখে উপবাস। সেই বিশেষ দিনের কথা মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। আর বললেই কি হবে? আমরা তো আর উৎসব করতে পারব না। যে দুজনকে নিয়ে বিবাহবার্ষিকী তার একজনকে দিয়ে উৎসব হয়না।
খুকি!
জ্বি বাবা।
বাবলুকে নিয়ে কি করা যায় বল তো মা –ও তো ভাল যন্ত্রণা করছে!
নেশা করার কথা বলছ?
এটা তো আছেই –বাড়ি বিক্রির তাল ধরেছে। আজ না-কি দালাল আসবে।
কখন আসবে?
সকালেই আসার কথা।
তুমি বাবা এসব নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাবে না। যা ইচ্ছা বাবলু বলুক, কিচ্ছু যায় আসে না। তোমার বাড়ি তুমি বিক্রি করবে না। এর উপর কথা কি? না কি তুমি বিক্রি করতে চাও?
না-না।
তাহলে সমস্যা কি?
না, কোন সমস্যা নেই।
বাবা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে গেলেন। আমি চলে গেলাম রান্নাঘরে। ঘুম ভাঙলেই বাবলু নাশতার জন্যে হৈচৈ শুরু করবে। তার জন্যই বোধহয় হৈচৈ-এর জন্যে হয়েছে।
চায়ের কেতলী চুলায় বসিয়েছি। পান্না ভাবীর কাজের মেয়েটি এক কাপ লবণ নিতে এল। পান্না ভাবী লবণ চেয়ে পাঠিয়েছেন। একটা চিরকুটও দিয়েছেন —
রাত্রি,
এক কাপ লবণ রাণীর হাতে দিয়ে দিও।
সময় করে এসো। কথা আছে।
–পান্না ভাবী।
পান্নাভাবী মানুষটা বেশ অদ্ভুত। দিনের মধ্যে তিন-চারবার স্লিপ পাঠাবেন। তাঁর রান্নাঘরে এক গাদা কাগজ সুতো দিয়ে বাঁধা। কাগজের সঙ্গে একটা পেনসিলও ঝুলছে। তিনি সেখান থেকে কাগজ ছিঁড়েন এবং স্লিপ লেখেন। রাত এগারোটায় একবার স্লীপ এল —
রাত্রি,
তোমার ভাই খেতে বসেছে। কাঁচামরিচ চাচ্ছে। রাণীর হাতে একটা কাঁচামরিচ পাঠিয়ে দাও (যদি থাকে)।
–তোমার পান্না ভাবী।
যদিও স্লিপ পাঠানোর কোন দরকার নেই, রাণী মুখে বললেই হয়। কিংবা তিনি দোতলার রেলিং ধরে দাঁড়ালেও আমার সঙ্গে কথা বলতে পারেন।