কিংবা এমনও হতে পারে, বাবলু যাবেই না। রাস্তায় নেমেই চিঠি ফেলে দেবে। গভীর রাতে বাসায় ফিরে উদাস গলায় বলবে –আপা, তোর এক্স-হাসবেণ্ডের কাছে গিয়েছিলাম। পেলাম না। কেউ নেই। ব্যাংকক-ফ্যাংকক চলে গেছে। বড়লোকের কারবার। এরা থুথু ফেলার জন্যেও ব্যাংকক চলে যায় …।
আমি নিজেও যেতে পারি। তবে কাল হল সোমবার আমার যাবার কথা মঙ্গলবার। একদিন আগেই না হয় গেলাম। টুকুনকে আগে কখনো আনতে যাই নি। এই প্রথম যাচ্ছি। মার দাবী কি খুব তুচ্ছ করার মত কিছু? ঝড় বৃষ্টিতে টুকুনও। বাবলুর মত ভয় পাচ্ছে নাতো? সেকি ভূমিকম্প শব্দটা বলতে পারে? আচ্ছা, আমি এইসব কি ভাবছি? কেনই-বা ভাবছি? টুকুন ভাল আছে। আনন্দে আছে। তার মার বাড়ির উঠোনে জমে থাকা ময়লা পানি দেখার জন্যে তার আসার দরকার। নেই।
ঝুম ঝুম শব্দে বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই। আষাঢ় মাসেও তো এত বৃষ্টি হয় না। আজ নিশ্চয়ই উঠোন ছাপিয়ে পানি একতলার ঘরে ঢুকে যাবে। একবার কি নিচে নেমে দেখে আসব? অন্ধকারে কোন কিছু দেখা যায় না, কিন্তু পানি দেখা যায়, অন্ধকারে পানি চকচক করতে থাকে। আচ্ছা, পানির কি নিজস্ব কোন আলো আছে?
বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ঝড় কমে এসেছিল। এখন আবার শুরু হয়েছে। বকুল গাছের আরেকটা ডাল কি ভাঙবে? আচ্ছা, রান্নাঘরের জানালা কি বন্ধ করে রেখেছিলাম? বন্ধ না করে থাকলে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।
পান্না ভাবী জেগেছেন। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কি যেন বলছেন। স্বামীকে বোধহয় ধমকাচ্ছেন। ঝড় বৃষ্টির মত একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবে আর তার স্বামী ধমক খাবেন না –তাতো হয় না। ঝড়ের শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে শুনতে পান্নাভাবীর চেঁচামেচি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুমের মধ্যেও শব্দ হতে থাকল। তবে সেই শব্দ আর ঝড়ের শব্দ থাকল না– ট্রেনের শব্দ হয়ে গেল। লম্বা একটা ট্রেন এঁকেবেঁকে ছুটছে, কোথাও থামছে না। কি দুলুনি সেই ট্রেনের!
সুন্দর সকাল
০৫.
ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে দেখি সুন্দর সকাল। ঝকঝকে রোদ। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। উঠোনে পানি জমেনি। রান্নাঘর লণ্ডভণ্ড হয়নি। বকুল গাছের ডাল ভাঙার শব্দ শুনেছিলাম। তেমন কিছু না, ছোট্ট একটা ডাল ভেঙেছে। অথচ রাতে মনে হয়েছিল পুরো গাছটা বুঝি ভেঙে পড়ে গেছে।
বাবা একতলার বারান্দায় চাদর গায়ে জবুথবু হয়ে বসে আছেন। তিনি আমাকে দেখে হাসলেন। হাসির ধরন অন্য রকম। যেন এই হাসির আড়ালে কোন মজার রহস্য আছে। সেটা কি? কলঘরের দিকে তাকিয়ে দেখি তকতক করছে। এটাই হল রহস্য। বাবা ফজরের নামাজ শেষ করেই বাড়ি ঝাঁট দিয়েছেন। যে জন্যে বকুল গাছের একটা পাতাও উঠোনে পড়ে নেই। বাবার বাড়ি পরিষ্কারের বাতিক আছে। হঠাৎ হঠাৎ এই বাতিক মাথাচড়া দিয়ে উঠে। তাঁর শরীর ভাল না। কিছুদিন থেকেই বুকে ব্যথা হচ্ছে। এ রকম বুকে ব্যথা নিয়ে এতটা পরিশ্রম করা কি উচিত? বাবাকে এইসব কে বোঝাবে?
শুধু বারান্দা এবং উঠোন না, বাথরুমও ঝকঝক করছে। দেয়ালে ঝুল জমেছিল, এখন কিছু নেই। দুটা বালতি কানায় কানায় পানি ভর্তি। পানি ভর্তি বালতি দেখে আজ যাত্রা শুরু। দিনটা হয়ত ভাল যাবে। চোখে-মুখে পানি দিতে দিতে ভাবছি– আজ কি নাশতা বানানো যায়? সকালে ঘুম ভাঙতেই নাশতার সমস্যাটা মেজাজ খারাপ করে দেয়। বাবলু পরোটা ছাড়া কিছু খেতে পারে না। অন্য কিছু নাকি তার গলা দিয়ে নামে না। গলার ফুটার কাছে আটকে থাকে। বাবা পরোটা খেতে পারেন না, তাঁর জন্যে খুব পাতলা করে রুটি বানাতে হয়। আমি নিজে দুটার কোনটাই খেতে পারি না। আমার পছন্দ হল পাতলা খিচুড়ি। এত পাতলা যে প্রায় স্যুপের মত। মজার ব্যাপার হল, পাতলা স্যুপের মত খিচুড়ি রান্নার কৌশল আমার জানা নেই। মার কাছ থেকে এই বিদ্যা যে শিখে রাখা দরকার ছিল তা কখনো মনে হয়নি। সব সময় মনে হয়েছে রান্নাবান্না শেখার দরকার কি? মা তো আছেনই। একবার শীতের সময় মা হঠ্যৎ এসে বললেন, ও খুকি, আয় তোকে একটা রান্না শিখিয়ে দেই। তোর বাবার খুব পছন্দের রান্না। কঁচা টমেটো পুড়িয়ে ভর্তা। আমি গল্পের বই পড়ছিলাম। বই থেকে মুখ না তুলেই বললাম, টমেটো ভর্তা বানানোর কৌশল আমি শিখতে চাচ্ছি না মা। গুপ্ত বিদ্যা তোমার কাছেই থাকুক। মা কিছু না বলে আমার বিছানার পাশে বসলেন। আমি বললাম, কিছু বলবে? মা বললেন, না। আমি বললাম, তাহলে দয়া করে উঠে যাও। আমি খুব দুঃখের একটা উপন্যাস পড়ছি। উপন্যাস পড়তে পড়তে আমি কাঁদতে শুরু করব। অন্যের সামনে কাঁদতে ভাল লাগে না। মা হাসিমুখে বললেন, কি বইরে খুকি? আমি বললাম, কি বই জেনে কি করবে? তুমি তো আর বই পড় না। মা আবারো হাসলেন। নরম গলায় বললেন, চা খাবি খুকী? চা বানিয়ে দেই? আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, চা খাব না। তুমি আর বিরক্ত করো না তো মা। মা ওঠে গেলেন, দশ মিনিটের মাথায় আবার ফিরে এলেন। একহাতে পিরিচে ঢাকা চায়ের কাপ, অন্য হাতে এক বাটি মুড়ি। তখন আমি বইটি পড়ে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছি। মা চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে হাসিমুখে বললেন, তুই কি যে পাগল! বই পড়ে কেউ এরকম কাঁদে? বইটা জানালা দিয়ে ফেলে দে তো। আমি বই মেঝেতে ফেলে দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কাঁদতে লাগলাম। মাকে জড়িয়ে ধরে সেই আমার শেষ কান্না।