চা বানিয়ে এনে দেখি টেবিলে মাথা রেখে বাবলু ঘুমুচ্ছে। নাক ডাকিয়ে ঘুম। তাকে অনেক করে ডেকে তুললাম, সে ঘুম ভেঙেই খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চায়ের কাপে দুটা চুমুক দিয়ে ঘুমুতে চলে গেল। তার যাওয়ার ভঙ্গি দেখে আমার একটু হিংসা লাগল। কি স্বাভাবিক একজন মানুষ! স্বাভাবিক এবং সুখি। পৃথিবীর কোন। দুঃখ-কষ্ট তাকে স্পর্শ করছে না। সে বাস করছে আনন্দময় ভুবনে …
অবশ্যি রাতের এই ঝড় বোধহয় তাকে কাবু করে ফেলেছে। নেশাও হয়ত কাটেনি। সে দরজা ধাক্কাচ্ছে পাগলের মত। ইচ্ছা করলেই আমি তার ভয় কমাতে পারি। ইচ্ছা করলেই আমি বলতে পারি –চেঁচামেচি করিস না। ভূমিকম্প-টম্প কিছু হচ্ছে না। ঝড় হচ্ছে। চুপ করে শুয়ে থাক। এতে কি বাবলু চুপ করবে?
বারান্দায় চটির ফটফট আওয়াজ আসছে। বাবার পায়ের চটির শব্দ এত সুন্দর! শব্দটার ভেতরই এক ধরনের ভরসা আছে। যেন বাবা তার চটির শব্দ দিয়ে জানাচ্ছেন –ভয় পাস না। আছি, আমি আছি। আমি তোদের পাশেই আছি।
বাবার চটির শব্দ বাবলুর ঘরের কাছে এসে থেমে গেল। বাবা কোমল গলায় ডাকলেন, বাবলু!
বাবলু কাঁপা গলায় বলল, ভূমিকম্প হচ্ছে বাবা। ভূমিকম্প হচ্ছে।
ঝড় হচ্ছে, ভূমিকম্প না।
বাবা, ঝড়-টর না, ভূমিকম্প হচ্ছে। তোমরা বুঝতে পারছ না।
আমার ঘরের একটা অংশ আলোকিত হল। বাবা টর্চলাইট জ্বেলেছেন। আশা করা যাচ্ছে, এই আলোয় বাবলু তার দরজার ছিটকিনি খুঁজে পাবে। হুড়মুড় শব্দ হল। বকুল গাছের ডাল ভেঙেছে নিশ্চয়ই। বাবার ঘরের লাগোয়া পুরানো একটা বকুলগাছ আছে। ঝড়-টর হলেই তার একটা ডাল ভাঙবে। ঝড় হয়েছে অথচ বকুলগাছের কোন ডালপালা ভাঙেনি এমন কখনো হয়নি।
ডাল ভাঙার শব্দ মিলিয়ে যাবার আগেই বাবলু আতঙ্কে অস্থির হয়ে চেঁচাল, কি হল বাবা? কি হল?
ডাল ভেঙেছে।
ডাল ভাঙল কেন?
তুই দরজা খুলে বের হয়ে আয়।
ছিটকিনি পাচ্ছি না।
টর্চ লাইট ধরে আছি। তুই শান্ত হ।
বাবলু ছিটকিনি খুঁজে পেয়েছে। খুট করে শব্দ হল। বাবা বললেন, তুই এমন হাঁপাচ্ছিস কেন? ভয়ের কি আছে?
ভূমিকম্প হচ্ছে! ভয় পাব না?
ধর, আমার হাত ধর।
পানি খাব বাবা।
বসে থাক, আমি পানি নিয়ে আসি।
আমি একা একা বসে থাকব না।
আচ্ছা, তুই আয় আমার সঙ্গে।
আমি তাদের পায়ের শব্দ পাচ্ছি। না, আমি শুধু চটি পায়ে বাবার যাবার শব্দই শুনছি, ধরে নিচ্ছি, বাবলুও সঙ্গে যাচ্ছে। খুব সম্ভব বাবার হাত ধরে ধরেই যাচ্ছে। একটা শিশু তার বাবার সঙ্গে ঝড়-বৃষ্টির রাতে যে ভাবে যাবে, বাবলু সে ভাবেই যাচ্ছে। সব মানুষের ভেতর একজন শিশু বাস করে। মাঝে মাঝে তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। বাবলুর ভেতরের শিশুটি মনে হয় সারাক্ষণ জেগে থাকে।
বড় ঝড় কখনো বৃষ্টি ছাড়া হয় না। আমার দেখা মতে এই প্রথম এত দীর্ঘ সময়। নিয়ে বৃষ্টিবিহীন ঝড় হল। এখন বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। আমাদের বাড়িটা পাকা দালান হলেও বারান্দাটা টিনের। টিনের ছাদে ঝনঝন শব্দ উঠছে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাবলু এবং বাবা ফিরছেন। আমি বাবলুর বিরক্ত গলা শুনলাম –এ কি, আমি তো ভিজে যাচ্ছি। বিরক্তি সে বাবার দিকে প্রকাশ করল। যেন তার ভিজে যাওয়ার দায়ভাগ বাবার।
বাবা শোনে, আমি একা একা এখন এই ঘরে ঘুমুতে পারব না।
আয়, আমার ঘরে চলে আয়।
না, আপনার ঘরে গেলে আমার ঘুম আসবে না।
তাহলে কি করবি?
আপনি আমার সঙ্গে ঘুমুবেন।
আচ্ছা চল।
আপনি দেয়ালের দিকে ঘুমুবেন বাবা। আমি দেয়ালের দিকে ঘুমুতে পারি না।
আচ্ছা তাই হবে।
বাবা, শিলাবৃষ্টি হচ্ছে নাকি?
না, সাধারণ বৃষ্টিই হচ্ছে।
সাধারণ বৃষ্টিতে এত শব্দ হবে কেন?
বাবা সেই সেই কেন প্রশ্নের জবাব দিলেন না। এখন বাবলুর কোন কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে না। সম্ভবত সে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবাকে জড়িয়ে ধরেই হয়ত ঘুমুচ্ছে। আমি জেগে আছি। বাবাও নিশ্চয়ই জেগে আছেন। আমি জানি, ইদানিং বাবার ঘুমের খুব সমস্যা হচ্ছে। আজকের রাতটা ঘুমুবার জন্যে খুব ভাল। প্রচণ্ড শীতে লেপের আরামদায়ক ওম, বৃষ্টি ও বাতাসের শব্দ। আজ রাতে শহরের লোকজন খুব আরাম করে ঘুমুবে। তারপরেও কেউ কেউ জেগে থাকবে। লেপের উষ্ণতা, বৃষ্টির ঘুমপাড়ানি শব্দেও তাদের ঘুম আসবে না। এ রকম লোকের সংখ্যা কতজন হবে? পাঁচ, দশ, পঞ্চাশ, হাজার … নাকি তার চেয়েও বেশি?
বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। সকালে ঘুম ভেঙে দেখব ভেতরে, উঠোনে পানি থৈ থৈ করছে। অল্প বৃষ্টিতেই পানি জমে যায়। আজ বৃষ্টি যা হচ্ছে আজ তো মনে হয় এক হাঁটু পানি জমে যাবে। এত পানি একসঙ্গে দেখতে পেলে টুকুন কি করতো? তার মাথা খারাপের মত হয়ে যেত। পানির সঙ্গে এই ছেলেটার কোন একটা যোগ আছে। পানি দেখলেই সে ছটফট করে ওঠে।
আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছি, খুব ভোরবেলায় বাবলুকে যদি পাঠিয়ে দেই টুকুনকে আনার জন্যে, তাহলে কি টুকুনকে মামুন পাঠাবে? বেশিক্ষণের জন্যে না, ঘণ্টাখানিকের জন্যে। বেশি হলে দুঘণ্টা। আসবে? দুঘণ্টা মার সঙ্গে থাকবে, তারপর চলে যাবে। দেশে না থাকলে ভিন্ন কথা। কিন্তু যদি থাকে তাহলেকি তারা তাকে আসতে দেবে? একটা চিঠি লিখে আমি বাবলুকে পাঠাতে পারি। তাতে কি লাভ হবে? বাবলু তো ঐ বাড়িতেই ঢুকতে পারবে না। দারোয়ান চিঠি হাতে নিয়ে যাবে। বাবলুকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে গেটের বাইরে। কিছুক্ষণ পর দারোয়ান এসে বলবে –সাহেব নাই।