মেয়েটি স্লীপ নিয়ে ঘরে ঢুকল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এসে বলল, স্যার আপনাকে আগামী মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে এগারোটার মধ্যে আসতে বলেছেন। এর আগে তিনি সময় করতে পারবেন না।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। মেয়েটা নরম গলায় বলল –স্লীপ না পাঠালে ভাল করতেন। আমি তিনটার সময় স্যারের ঘরে আপনাকে ঢুকিয়ে দিতাম। মেয়েটা স্লীপটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল –স্লীপটা নিয়ে যাবেন?
আমি হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে নিলাম –কাগজে লিখেছিলাম –টুকুনের মা।
.
০৪.
শেষরাতে প্রচন্ড শোঁ শোঁ শব্দ, দমকা বাতাস।
আমাদের বারান্দায় ঝুলন্ত তারের মাথায় চল্লিশ পাওয়ারের যে বাতি সারারাত জ্বলে, সেই বাতি খুব দুলছে। আমি অবশ্যি বাতির দুলুনি দেখছি না আমার ঘর থেকে বারান্দা দেখা যায় না তবে এই দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতরে আলো এবং ছায়াও দুলছে। বাহ, ভাল লাগছে তো! আমার ঘরটাকে নৌকার মত লাগছে। না ঘর না, আমার বিছানাটাকে নৌকার মত লাগছে। পালতোলা নৌকা, মাথার উপরে মশারিটা হল নৌকার পাল। আমি লেপের ভেতর ঢুকে পড়লাম। ঝড়-বাদলার সময় লেপের ভেতর গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকতে ভাল লাগে। শোঁ শোঁ শব্দ খুব বাড়ছে, দমকা বাতাস জোরালো হচ্ছে। প্রচণ্ড শব্দে খুব কাছেই কোথাও বাজ পড়ল। নিশ্চয়ই কোন লাইটপোস্টের উপর। বারান্দার বাতি নিভে গেল। এই বাতির সঙ্গে শহরের সব বাতিও সম্ভবত নিভে গেল। কি গাঢ় কি তীব্র অন্ধকার!
এইবার বোধহয় বাবলু জেগেছে। পাশের ঘর থেকে খটখট শব্দ পাচ্ছি। বাবলু নিশ্চয়ই বাতি জ্বালাবার চেষ্টা করছে। এক্ষুণি সে কিছু একটার সঙ্গে ধাক্কা খাবে, চায়ের কাপ বা গ্লাসটাস কিছু ভেঙে দারুণ চেঁচামেচি শুরু করবে। আমি ছুটে গিয়ে দেখব, হাত কেটে ফেলেছে। রক্ত পড়ছে।
বাবলু দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে চেঁচাচ্ছে –রাত্রি, এই রাত্রি। ভূমিকম্প হচ্ছে। ভূমিকম্প!
আমি নিজের মনে হাসলাম। ভয় পেলে বাবলু প্রথম যে বাক্যটি বলবে তা হল, ভূমিকম্প হচ্ছে। ভূমিকম্প। এখন সে যা করবে তা হল পাগলের মত দরজা খুঁজে বেড়াবে। কিন্তু খুঁজে পাবে না। দরজা পেলেও দরজার ছিটকিনি খুঁজে পাবে না। এক সময় বাইশ-তেইশ বছরের এই যুবক বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করবে।
বাবলু প্রচণ্ড শব্দে দরজায় লাথি দিচ্ছে। এখনো কাঁদতে শুরু করেনি, তবে শুরু করবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু করবে। আমি জেগে আছি, কিন্তু আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বাবলুর সঙ্গে আজকাল আমার একেবারেই কথা বলতে ইচ্ছা করে না। কাল রাতে আবার মদ খেয়ে এসে খুব হৈ-চৈ শুরু করল। বাবা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হৈ-চৈ শুনে উঠে এসে অবাক হয়ে বললেন, কি হয়েছে?
বাবলু হাসিমুখে বলল, কিছু হয়নি তো বাবা। আপনি উঠে এসেছেন কেন? আপনি ওল্ডম্যান। আপনার রেস্ট দরকার।
চেঁচাচ্ছিস কেন?
বাবলুর মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হল। এক ধরনের সুখি-সুখি গলায় বলল, আমি চেঁচাচ্ছি না। আপনার মেয়ে চেঁচাচ্ছে। আপনার মেয়ে আমার সঙ্গে মেজাজ করছে। ভাত দিতে বলছি, ভাত দিচ্ছে না। গেটের দরজাও খুলছিল না। আমি প্রায় আধঘণ্টা ধরে দরজা ধাক্কালাম, কড়া নাড়লাম। নো রেসপন্স। আমাকে সে মানুষ বলেই মনে করে না।
বাবা ক্লান্ত গলায় বললেন, রাত্রি মা, বাবলুকে খেতে দে।
বাবুল মধুর স্বরে বলল, তুমি শুয়ে পড় বাবা। আমার জন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না। কেউ আমার জন্যে ভাবুক এটা আমি চাইও না। তুমি আরাম করে ঘুমাও। তোমার ঘুম দরকার, রেস্ট দরকার।
কিছুক্ষণ আগেই বাবাকে সে আপনি আপনি করছিল, এখন তুমি তুমি করছে। নেশা করলে তার এই অবস্থা হয়।
বাবা চটি ফটফট করে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। মেঝের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গির হাঁটা। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হতাশ একজন মানুষ। তিনি বিছানায় শুয়ে থাকবেন, কিন্তু ঘুমুবেন না। যত রাতই হোক আমি যদি তার ঘরের কাছের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ডাকি –বাবা! তিনি সঙ্গে সঙ্গে কোমল গলায় বলবেন, কি হয়েছে রে মা! জীবনের শেষ দিনগুলি তিনি হয়ত জেগে জেগেই কাটাবেন।
আমি বাবলুকে ভাত বেড়ে দিলাম। সে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসল। আমি জানি সে কিছুই খেতে পারবে না। নেশা করে সে যখন আসে, কিছুই খেতে পারে না। খানিকক্ষণ ভাত নাড়াচাড়া করে উঠে পড়ে। আজও উঠে পড়বে। কিন্তু খেতে দেবার সময় তাকে খুব গুছিয়ে খাবার দিতে হবে। আলাদা প্লেটে কাঁচামরিচ, লবণ, পেঁয়াজ। কাঁচামরিচ না থাকলে শুকনো মরিচ তেলে কড়া করে ভেজে দিতে হবে।
খেতে বসে বাবলু ভুরু কুঁচকে বলল, আইটেমের অবস্থা তো খুবই খারাপ। রাস্তার ফকির-ফাঁকারও এরচে ভাল খায়। তুই ডিম ভেজে নিয়ে আয়। ডিম আছে না?
আছে। কিন্তু ডিম তো তুই খাবি না, এক কণা মুখে দিয়ে খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়বি।
ভাল করে ডিম ভেজে আন তো। খিদেয় আমার নাড়ি জ্বলে যাচ্ছে …।
আমি ডিম ভেজে আনলাম। বাবলু যথারীতি ডিম ভাজা নাড়াচাড়া করতে লাগল। আমি বলাম, খাবি না?
বাবলু বলল, খিদেটা হঠাৎ ভ্যানিস হয়ে গেল। বেশি খিদে লাগলে এটা হয় –হঠাৎ খিদে চলে যায়। চা খাব। আগুন মার্কা চা।
তুই চাও খাবি না। এক চুমুক দিয়ে রেখে দিবি …
আরে না, চা খেতে হবে। চা বানিয়ে আন্তু রন্ত চা নিয়ে আসবি। তুরন্ত কি জানিস তো? তুরন্ত হচ্ছে ভেরি কুইক। বিনা চিনির চা। ডায়াবেটিসের ব্যাপারে আগে থেকে প্রিকশান নিচ্ছি। তুইও বিনা চিনির চা খাওয়া অভ্যাস কর, নয় তো বুড়ো বয়সে কষ্ট পাবি। দিনের মধ্যে পঞ্চাশবার বাথরুমে যেতে হবে। মেয়ে ছেলের জন্যে সেটা খুবই অপমান জনক।