ওতো শুনেছি দেশের বাইরে।
আমার কেন জানি মনে হয় এখন সে দেশেই আছে। বাচ্চা একটা ছেলে। এতদিন বাইরে থাকবে না।
বাবা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, তোমার কি ধারনা আমি টুকুনকে নিয়ে আসতে পারব না?
ওরা কি দেবে?
হ্যাঁ দেবে।
কখন যাবি?
দুপুরে যাব।
দুপুরে কেন এখন চলে যা–
না এখন না। আমি ওদের কি বলব না বলব তা খুব সুন্দর করে আগে গুছিয়ে নেব। আমার সময় লাগবে।
বাবার চোখ চকচক করছে। তিনি হাসলেন। আনেকদিন পর বাবার হাসিমুখ দেখলাম। এই বাড়িতে হাসি নেই বললেই হয়। আমরা কেউ হাসি না। শুধু মা হাসতেন। কথায় কথায় হাসতেন। হয়ত দেয়ালে বসা একটা টিকটিকি টিকটিক করে উঠল। মা চেঁচিয়ে বলবেন, ও খুকি শুনলি টিকটিকিটা কেমন চিকণ গলায় টিকটিক করল –হি হি হি। আমার ধারনা মা তার সঙ্গে সব হাসি নিয়ে চলে গেছেন। কোন একদিন আবার একজন কেউ সব হাসি নিয়ে ফিরে আসবে। সেই একজন কে? সেকি টুকুন? না টুকুন না। টুকুনও হাসতে জানে না। সে জন্ম থেকেই গম্ভীর। দু বছর বয়সেই সে কেমন ভুডু কুঁচকে তাকাত। জটিল জটিল সব বাক্য তৈরী করত। একবার সে বলল, মা আমার জুতায় কংকর। কি অদ্ভুত কান্ড। কংকর শব্দটা তাকে কে শেখাল। এমন কঠিণ শব্দ আমি নিজে কখনো বলি না। তার বাবা কি শিখিয়েছে। আমি মামুনকে বললাম, আচ্ছা টুকুনকে কংকর শব্দটাকি তুমি শিখিয়েছ?
সে টুকুনের মতই ভুডু কুঁচকে বলল –কংকর মানে কি? আমি কংকর টংকর শেখাব কেন? তাছাড়া বাচ্চাদের কিছু শেখাতে হয় না –দে পিক আপ ওয়াইস।
কোত্থেকে পিক আপ করে?
কে জানে কোত্থেকে? এটা এমন জরুরী কোন সমস্যা না। এটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন? টংকর কংকর যা ইচ্ছা বলুক। কথা শিখছে –এটাই কথা।
অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ শিখছে …।
কংকর কোন অদ্ভুত শব্দ না। অল্পতে উত্তেজিত হয়ো না তো।
আমার তিন বছরের বিবাহিত জীবনে মামুন আমাকে অল্পতে উত্তেজিত না। হবার জটিল বিদ্যা শেখানোর চেষ্টা করেছে। আমি শিখতে পারিনি। এই কঠিণ বিদ্যা শিখেছি তাকে ছেড়ে চলে আসার পর। উত্তেজিত হওয়া বা বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা আজ আমার নষ্ট হয়ে গেছে।
বাবা!
উ।
বাবলুকে ধরে একটা বিয়ে দিয়ে দিলে কেমন হয়?
বাবা বিরক্ত গলায় বললেন, বিয়ে?
হু বিয়ে। ফুটফুটে একটা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে। সারা বাড়ি জুড়ে ছোটাছুটি করবে। এই ছাদে উঠবে, এই ছাদে নামবে। বাবলুর সঙ্গে ঝগড়া করবে, আবার ঝগড়া মিটমাট হবে।
জেনেশুনে অগাটার সঙ্গে একটা মেয়ের বিয়ে দেব। একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করব?
উল্টোটাও হতে পারে। বিয়ে দেবার কারণে মেয়েটা বাবলুকে ঠিকঠাক করে ফেলতে পারে।
যদি ঠিকঠাক করতে না পারে?
না পারলে মেয়েটার জীবন ছাড়খাড় হয়ে যাবে। মনের কষ্টে হয়ত সে বিষ খাবে, কিংবা ছাদ থেকে লাফিয়ে রাস্তায় পড়ে যাবে। এটা হল মেয়ে হয়ে জন্মানোর খেসারত। ভয়ংকর এক্সপেরিমেন্ট মেয়েদের দিয়েই করানো হয়।
বাবা বললেন –এ রকম কোন এক্সপেরিমেন্ট আমি করব না। ভুলেও এইসব মাথায় স্থান দিবি না। ভুলেও না। জেনেশুনে এক নেশাড়ুর সঙ্গে একটা মেয়েকে জুড়ে দেব। তুই আমাকে এত ছোট ভাবলি?
বাবলু ফিরে এসেছে। উঠোনে বসে দাঁত মাজছে। তার টুথপেস্ট আছে। ব্রাশ আছে। কিন্তু এখন দাঁত মাজছে লবণ দিয়ে। আঙ্গুলের ডগায় লবন নিয়ে সমানে ডলছে। তার কোন জ্ঞানী বন্ধু-বান্ধব হয়ত তাকে বলেছে লবন দিয়ে দাঁত মাজলে দাঁত ভাল থাকে।
আজ নাশতা খাব না, পান্নাভাবীর ওখানে নাশতার দাওয়াত।
আচ্ছা শুনলাম।
আজ দুপুরেও কিছু খাব না –দুপুরেও দাওয়াত। বজলুর বোনের বিয়ে। বজলুকে চিনেছতো? আসে মাঝে মাঝে জোড়া ভুডু … ওর বোনটারও জোড়া
ভাল।
আপা রাতে ফিরতে দেরি হবে। বজলুর বোনের বরের নারায়ণগঞ্জে নিজের বাড়ি –বরকনেকে ঐ বাড়িতে পৌঁছে তারপর আসতে হবে। রাতেও কিছু খাব না। তোদের অনেক পয়সা বাঁচিয়ে দিলাম। তিনবেলার খোরাকির খরচ বেঁচে গেল। এই জমানায় তিনবেলার খোরাকী বাঁচা সহজ কথা না।…
বাবলু দাতে লবন ঘসতে ঘসতে কথা বলে যাচ্ছে। আমি লক্ষ্য করলাম, বাবা তার কথা মন দিয়ে শুনছেন। বাবার চোখের দৃষ্টিতে হতাশা ও ক্লান্তি। এই বাবলু প্রথম যখন কথা শিখল তখনও নিশ্চয়ই তিনি এমনই মন দিয়ে তার কথা শুনতেন। তার প্রতিটি শব্দ শুনে তার মন নিশ্চয়ই আনন্দে অভিভূত হতেন …..
মামনুদের অফিসের কর্মচারীদের কেউ আমাকে চেনে না। কিংবা চিনলেও তারা এমন কিছু করল না যাতে মনে হতে পারে আমি তাদের পরিচিত। একজন মহিলা সেক্রেটারী মিষ্টি গলায় বললেন– এম ডি সাহেবতো এখন খুব ব্যস্ত। লাঞ্চ আওয়ার। লাঞ্চ আওয়ারে তিনি কারো সঙ্গে দেখা করেন না। আপনি তিনটার পর আসুন।
আমি বললাম, খুব জরুরী একটা দরকার ছিল।
মেয়েটি মিষ্টি করে হেসে বলল –এখন দেড়টা বাজে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনটা বাজবে। যত জরুরী কথাই থাকুক দেড় ঘন্টায় তেমন কোন ক্ষতি বোধহয় হবে না।
একটা কাগজ দিন। আমি একটা স্লীপ লিখে দি। স্লীপটা উনাকে দেখান।
মেয়েটি আবারো হাসল। মাথার চুল ঠিক করতে করতে বলল, আপনার কথা। থেকে মনে হচ্ছে স্লীপটা পাঠালেই স্যার আপনাকে ডেকে পাঠাবেন। কিন্তু আপনি আমার দিকটা দেখুন। আমরা কাজটা হচ্ছে একটা থেকে তিনটা পর্যন্ত কেউ যেন স্যারের সঙ্গে দেখা করতে না পারে সেটা দেখা। যাই হোক –এই নিন কাগজ। স্লীপ কি লিখতে চান লিখুন। সঙ্গে কলম আছে?