- বইয়ের নামঃ জয়জয়ন্তী
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, প্রাপ্ত বয়স্কদের বই
একটা স্বপ্ন
জয়জয়ন্তী – উপন্যাস – হুমায়ূন আহমেদ
একদা এমনই বাদলশেষের রাতে–
মনে হয় যেন শত জনমের আগে
সে এসে, সহসা হাত রেখেছিল হাতে,
চেয়েছিল মুখে সহজিয়া অনুরাগে।
সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে;
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে।
একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী।
–(শাশ্বতী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)
০১.
আমি ঘুরে-ফিরে একটা স্বপ্নই দেখি –মামুন এবং আমি পাশাপাশি একটা রিকশা করে যাচ্ছি। রিকশার চাকার সঙ্গে কি করে যেন শাড়ি পেঁচিয়ে গেল। আমি চেঁচিয়ে বলছি –রিকশা থামাতে বল, রিকশা থামাতে বল। মামুন চিৎকার করছে –এই রিকশা, থাম্ থাম। কিন্তু রিকশাওয়ালা কিছুই শুনছে না –সে সমানে প্যাডেল করে যাচ্ছে। আশেপাশে লোক জমে যাচ্ছে। একজন ট্রাফিক পুলিশ পর্যন্ত রিকশা থামাবার জন্য ছুটে আসছে … স্বপ্নের এই জায়গায় আমি জেগে উঠি। আমার বুক ধ্বক ধ্বক করতে থাকে। পানির পিপাসা হয়। নিজেকে ধাতস্থ করতে অনেক সময় লাগে। বিছানায় চুপচাপ বসে হাঁপাতে থাকি। এই সময় বাবা এসে আমার দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলেন, কি হয়েছে রে মা? কি হয়েছে?
বাবার ঘর দোতলার শেষ মাথায়। রাতে তার ঘুম হয় না বললেই হয়। তিনি সামান্য শব্দেই চটি পায়ে বের হয়ে আসেন। আমি দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে যে শব্দ করি তা নিশ্চয়ই সামান্য না।
আমার পাশের ঘরে বাবলু ঘুমায়। তার ঘুম অবশ্যি কখনো ভাঙে না। আমার মত সেও দুঃস্বপ্ন দেখে। তার দুঃস্বপ্নগুলি বিকট এবং বারবার। সে বিশ্রী ধরনের গোঙানির শব্দ করতে থাকে, হাত-পা ছুঁড়তে থাকে। আমি নিজেই ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ি। বাবা ছুটে এসে দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলেন –কি হয়েছে? এই বাবলু, এই! দরজা খোল, দরজা খোল। বাবলুর দুঃস্বপ্নগুলি সহজে ভাঙে না। সে গো গো শব্দ করতে থাকে এবং বিছানায় নড়াচড়া করতে থাকে। এক একবার মনে হয়, বিছানা থেকে গড়িয়ে বোধহয় মেঝেতে পড়ে যাবে। বাবা ভয় পেয়ে আমাকে ডাকেন –রাত্রি! রাত্রি মা! আমি বাবার পাশে দাঁড়াই। দুজনে মিলে দরজা ধাক্কাতে থাকি। এক সময় বাবলুর ঘুম ভাঙে কিন্তু চেতনা পুরোপুরি ফিরে আসে না –কারণ সে কাঁপা গলায় ডাকতে থাকে –মা! মা! বাতি জ্বালাও মা। তার মনে থাকে না যে। মা মারা গেছেন আট বছর আগে। ছেলের দুঃস্বপ্নের সময় তিনি এসে বাতি জ্বালাতে পারবেন না।
বাবা ব্যস্ত হয়ে ডাকেন –ও বাবলু! বাবলু!
বাবলু ক্লান্ত গলায় বলে, জ্বি।
আমরা আছি এখানে। আমি আছি, রাত্রি আছে। কি হয়েছে রে?
বোবায় ধরেছে।
দরজা খুলে বের হয়ে আয়।
বাবা, পানি খাব।
দরজা খোল –পানি নিয়ে আসছি।
পানি আনার জন্যে বাবা নিজেই চটি ফটফট করতে করতে একতলায় নেমে যান। বাবলু দরজা খুলে আমাকে দেখে বোকার মত হাসে।
বোবায় ধরেছিল। বুঝলি আপা, বুকের উপর চেপে বসেছিল– আজ আমাকে মেরেই ফেলত।
আয়, বারান্দায় খানিকক্ষণ বোস।
একটা তাবিজ-টাবিজ কিছু নিতে হবে –নয়ত বেকায়দায় ফেলে ভূতটা আমাকে মেরেই ফেলবে।
ভূত-টুত কিছু না। তুই স্বপ্ন দেখছিলি।
আরে রাখ। স্বপ্ন আর বোবায় ধরা এক জিনিস না। বোবায় যাকে ধরে সে জানে। বোবা করে কি জানিস? প্রথমে একটা স্বপ্ন দেখায় –ভয়ের স্বপ্ন। তারপর বুকের উপর চেপে বসে গলা চেপে ধরে। নিঃশ্বাস নিবি সেই উপায় নেই, নড়াচড়া করবি সেই উপায় নেই। সাধারণ নিয়ম হল –একটা বোবা একজনকে ধরে। আমার সবই উল্টা। আমার কাছে দু’টা বোবা আসে। একটার বয়স কম। সেটা চুপচাপ আমার পায়ের উপর বসে থাকে।
বাবা পানি নিয়ে আসেন। বাবলু এক চুমুক পানি খায়। সে পানি খেতে পারে না। তার গলার ফুটাটা না-কি এমন যে ফুটা দিয়ে সব খাবার নামে, শুধু পানি নামে না। পানি জমা হয়ে থাকে।
এক চুমুক পানি খেয়েই বাবলু সুস্থ হয়ে আবার ঘুমুতে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার নাক ডাকার শব্দ আসতে থাকে।
আমার দুঃস্বপ্ন বাবলুর দুঃস্বপ্নের মত ভয়ংকর না, কিন্তু আমি বাবলুর মত চট করে ঘুমুতে পারি না। আমি জেগে থাকি –জেগে জেগে ভাবি –রিকশায় শাড়ি পেচানোর এই স্বপ্ন আমি কেন বার বার দেখি?
প্রথম কথা হচ্ছে, মামুনের সঙ্গে আমি কখনো রিকশায় চড়িনি। তার রিকশ ভীতি আছে। ছোটবেলায় সে ঝাঁকুনি খেয়ে রিকশা থেকে নিচে পড়ে মাথায় চোট পেয়ে অনেকদিন হাসপাতালে ছিল। তারপর থেকেই সে রিকশায় চড়ে না। প্রয়োজনে সে হাঁটবে, বাসে চড়বে, কিন্তু কখনো রিকশায় না। বিয়ের পর আমরা ঘুরতাম ওদের মরিস মাইনর গাড়িতে। গাড়ি চালাতো মামুন, আমি তার পাশে বসা এবং পেছনের সীটে ওদের ড্রাইভার। মামুন খুব ভাল গাড়ি চালায়, তারপরেও গাড়িতে উঠলেই সে ড্রাইভারকে সঙ্গে নেবে। তাদের বাড়ি থেকে নিউমার্কেট যাবে, পাঁচ মিনিটের পথ –পেছনে ড্রাইভার থাকবেই। তার যুক্তি হচ্ছে –আমি গাড়ির কলকজার কিছুই জানি না। গাড়ি পথে বিগড়ে গেল –তখন করবটা কি? তাছাড়া ধর, একটা একসিডেন্ট করলাম। ঢাকা শহরের জাগ্রত জনতা আমাকে ঘিরে ধরল। মেরে তক্তা বানানোর মতলব করছে। তখন নিজের একজন মানুষ লাগবে যে আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। প্রয়োজনে জীবন তুচ্ছ করে পুলিশ ডেকে আনবে। ড্রাইভার সঙ্গে রাখার এই হল ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি।