চুপ। চুপ।
বয়স্ক অপরিচিত এক ভদ্রলোক বললেন, ভিতরে নিয়া যান। যা হওনের হইছে। আব্দুল মতিন কঠিন গলায় বলল, যেটা জানেন না সেটা নিয়ে কথা বলবেন না। এর ছোট বোন বেশ্যাবৃত্তি করে এটা জানেন?
অরু জলভরা চোখে টুকুর দিকে তাকিয়ে বলল, চল, চলে যাই।
টুকু বলল, চল।
অরু তার ছেলের দিকে তাকাল। সুমনের চোখে অপরিচিতের দৃষ্টি। যেন মাকে সে চিনতে পারছে না।
টুকু বোনের হাত ধরল। কোমল গলায় বলল, চল আপা; এতগুলি মানুষ তাদের চারপাশে। কেউ কিছুই বলল না।
রাত দু’টায় ঢাকা যাওয়ার একটা ট্রেন আছে। তারা স্টেশনে বসে রইল। টুকু ভেবেছিল আপা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। দেখা গেল অরু বেশ শক্তই আছে। টুকু বলল, কিছু খাবে আপা?
অরু বলল, টাকা আছে?
আছে কিছু।
টিকিট কাটার তো টাকা লাগবে। ঐ টাকা আছে?
আমার টিকিট লাগবে না। তোমার টিকিটা কাটিব।
তাহলে যা কিছু কিনে আন। খুব ক্ষিধে লেগেছে।
পরোটা ভাজি আনব আপা?
আন।
টুকু পরোটা, আলুভাজি আর কলা নিয়ে এল। অরুণ বেশ আগ্রহ করেই খেল। তার সত্যি সত্যিই খুব ক্ষিধে পেয়েছিল।
আপা।
কী রে?
আমার কী মনে হচ্ছে জানো? আমার মনে হচ্ছে–ওরা আমাদের খোঁজে স্টেশনে আসবে। বাড়িতে মুরুব্বি আছে, তারা যখন শুনবে তখন…
অরু সহজ গলায় বলল, কেউ আসবে না। টুকু, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। কী করি বল তো? কয়েক রাত ঘুম হয়নি এখন ঘুমে একেবারে চোখ জড়িয়ে আসছে।
মেয়েদের ওয়েটিং রুমে বেঞ্চিতে শুয়ে ঘুমাও। চল যাই।
চল।
লম্বা কাঠের বেঞ্চিতে অরু কুণ্ডুলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। মাথার নিচে হ্যান্ড ব্যাগ। শোবার সঙ্গে সঙ্গেই সে ঘুমিয়ে পড়ল। টুকু সারাক্ষণই বোনের পাশে বসে রইল। এক সময় দেখল ঘুমের মধ্যেই অরু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত টুকুর প্রথম গল্পে এই দৃশ্যটি ছিল। চমৎকার একটি গল্প, যদিও বেশির ভাগ মানুষই এই গল্প পড়ল না। পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক কী মনে করে জানি টুকুকে একটি চিঠি লিখলেন। সেই চিঠিতে অনেক খানি উচ্ছ্বাস ছিল। সাহিত্য সম্পাদকরা কখনো এই জাতীয় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন না।
বাড়ি ফিরেও অরু, তেমন কোনো আবেগ বা উচ্ছ্বাস দেখাল না। মনে হল জীবনের কঠিন বাস্তবকে সে সহজভাবেই গ্রহণ করেছে। একবারও নিজের বাচ্চা দু’টির কথা বলল না। তিথিকে বলল, তুই কী আমার জন্যে কোনো চাকরি-টাকরি জোগাড় করে দিতে পারবি?
তিথি বলল, আমি চাকরি কোথায় পাব আপা?
অরুণ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তাও তো ঠিক। যে কোনো ধরনের চাকরি হলেই হয়। আয়ার কাজও করতে পারি। আজকাল তো শুনেছি বড়লোকদের বাড়িতে বেতন দিয়ে আয়া রাখে।
আমি এইসব খোঁজ রাখি না আপা।
পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দিলে লাভ হবে?
জানি না আপা।
তোর তো অনেকের সঙ্গে জানাশোনা সবাইকে যদি বলে-টলে রাখিস…
আমার সঙ্গে কারোর কোনো জানাশোনা নেই, এইসব নিয়ে আমাকে বিরক্ত করো না তো আপা।
আচ্ছা আর বিরক্ত করব না।
দিন পনের পরে আব্দুল মতিনের পক্ষ থেকে উকিলের চিঠি এসে উপস্থিত হল। সেই চিঠির বক্তব্য হচ্ছে আব্দুল মতিন তার স্ত্রীর সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে না। কারণ তার স্ত্রী নষ্ট চরিত্রের অধিকারী। আব্দুল মতিন স্ত্রীর চরিত্র সংশোধনের অনেক চেষ্টা করেও সফলকাম হয়নি। স্ত্রীর কারণে সে সামাজিকভাবে অপদস্ত হয়েছে। মানুষের সামনে মুখ দেখাতে পারছে না। কাজেই সে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের এবং দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সাক্ষী রেখে তার স্ত্রী শাহানা বেগম ওরফে অরুকে ইসলামী বিধি মোতাবেক তালাক দিচ্ছে।
এই চিঠিতেও অরুর কোনো ভাবান্তর হল না। মনে হল সে আগে থেকেই জানত এ ধরনের একটি চিঠি আসবে। মিনু খুব কান্নাকাটি করতে লাগলেন।
জালালুদ্দিন গম্ভীর হয়ে বললেন, কান্নাকাটি করে লাভ নেই, সবই কপালের লিখন। শুধু বংশের ওপর একটা দাগ পড়ে গেল–এটাই আফসোসের কথা। এত বড় বংশ।
হীরু খুব চোঁচামেচি করতে লাগল, হারামজাদা ভেবেছে কী, হারামজাদাকে আমি হাইকোর্টে নিয়ে তুলব। জেলের ভাত খাওয়াব। জেলের মোটা ভাত পেটে পড়লে বুঝবে লাইফ কাকে বলে। এমনি এমনি ছাড়ব আমি সেই পাত্রই না। কাস্টডি মামলা করব। সুমন, রিমন থাকবে তার মা’র সাথে।
অরু বলল, চেঁচাস না তো–চুপ কর।
চুপ করব কেন? কাস্টডি মামলা করলে বাপ বাপ করে সুমন, রিমনকে দিয়ে যাবে।
ওদের এখানে দিয়ে গেলে লাভ কী হবে? খাওয়াব কী? যেখানে আছে, ভালই আছে। তুই খামোখা চিৎকার করিস না।
তোমার নিজের বাচ্চাদের জন্য তোমার হার্টে কোনো ‘লাভ’ নেই?
না।
বল কী?
এত গাধা তুই কী করে হলি, বল তো হীরু?
গাধা?
হ্যাঁ গাধা। যত দিন যাচ্ছে তুই ততই গাধা হচ্ছিস।
হীরু মন খারাপ করে বেরিয়ে গেল। মেয়েছেলের মতিগতি বোঝা খুব মুশকিল। ভাল বললে মন্দ বুঝে। কী অদ্ভুত একটা জাত আল্লাহতালা সৃষ্টি করেছেন। এই জাতের মুখের দিকে তাকানও উচিত না। নিমক হারাম জাত।
নারী জাতির ওপর হীরুর ভক্তি-শ্রদ্ধা কোনো কালেই বেশি ছিল না। ইদানীং নারী জাতিকে সে সহ্যই করতে পারছে না। কারণ এ্যানার বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেছে। এ্যানার মা হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে মেয়ে বিয়ের জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন। শেষপর্যন্ত যে ছেলেটির সঙ্গে বিয়ে ঠিকঠাক হয়েছে সে ডাক্তার। প্রাইভেট ক্লিনিকে চাকরি করে। চেহারাও ভাল। অপছন্দ করার মত কিছু তার মধ্যে নেই। হীরু খোঁজ নিয়ে জেনেছে। ইতিমধ্যে এ্যানা দু’দিন সেই ডাক্তারের সঙ্গে চাইনিজ খেতে গিয়েছে।