এ্যানার বাবা ইসমাইল সাহেবের কাজকর্ম একজন জেলের সুপারিনটেনডেন্টের মত। যতক্ষণ বাসায় থাকবেন কোনো মেয়ে ঘর থেকে বেরুতে পারবে না। উকি-কুঁকি দিতে পারবে না। ঘরের জানালা থাকবে বন্ধ। আজকের লক্ষণও সে রকম। হীরু ঠিক করল। মীরপুর গিয়ে দেখে আসবে। ভদ্রলোক অফিসে গেছেন না। ছুটি নিয়ে বাসায় বসে আছে। যদি অফিসে না গিয়ে থাকেন তাহলে তো কিছুই করার নেই। আর যদি দেখা যায়। ভদ্রলোক অফিসেই আছেন তাহলে আরেকটা এটেম্পট নেয়া যায়। এত সহজে হাল ছেড়ে দেয়া ঠিক না।
ভদ্রলোক অফিসেই আছে। বিশাল চেহারা। ব্যাঙের চোখের মত বড় বড় চোখ। কচকচ করে পান খাচ্ছে। হীরু মনে মনে বলল, খাঁ ব্যাটা পান খা। আর প্রতি বছর একটা করে মেয়ে পয়দা করা। বলেই হীরুর মনে হল–বলাটা ঠিক হল না। তার শ্বশুর হবার একটা ভীষণ সম্ভাবনা এই কোলা ব্যাঙের আছে। হবু শ্বশুর সম্পর্কে এরকম মন্তব্য করা ঠিক না। শ্বশুরদের সম্পর্কে ভক্তিশ্রদ্ধা থাকা দরকার। তবে এই লোক তার শ্বশুর হলেও বিপদ আছে। ঈদের দিন কোলাকুলি করতে হবে।
হীরু একটা রিকশা নিয়ে নিল। মীরপুর থেকে কল্যাণপুর ফেরার এই সময়টায় বাসে গাদাগাদি ভিড় থাকে। এ্যানার সঙ্গে দেখা হবে ভেবে ইস্ত্রী করা শার্ট পরে এসেছে। চাপাচাপিতে শার্ট ভর্তা হয়ে যাবে। রিকশা ভাড়ায় বাড়তি টাকা চলে যাচ্ছে। উপায় আর কি?
এ্যানার সঙ্গে তার পরিচয় দীর্ঘদিনের নয়। আড়াই মাসের মত। পরিচয় পর্বটা খারাপ না। এসএসসি পরীক্ষায় দ্বিতীয় দিন। হীরু মীরপুর রোডে এসে দাঁড়িয়েছে কি করবে। ঠিক বুঝতে পারছে না। বছর তিন চারেক আগে এই সময়ে মেয়েদের স্কুলে নকল সাপ্লাই করত। বয়সের কারণে এটা এখন মানায় না। তবু পরীক্ষার সময় গম্ভীর মুখে একবার ঘুরে আসে। অনেক দিনের অভ্যাস। চট করে ছাড়া মুশকিল।
হীরু ভাবছিল কোন স্কুলে যাবে। আশপাশের সব কটা সেন্টার ঘুরে দেখা দরকার। রোজ রোজ একই সেন্টারে যাবার কোনো মানে হয় না। এই রকম যখন তার মনের অবস্থা তখনি এ্যানাকে তার চোখে পড়ল। বেচারী রিকশা পাচ্ছে না। কোনো রিকশা নেই। যাও আছে যাত্রী বোঝাই। মেয়েটা ছোটাছুটি করছে রিকশার জন্যে। ব্যাপারটা দেখতেই হীরুর বেশ মজা লাগছে। মেয়েটা দারুণ ভয় পেয়েছে। তার হাত থেকে এক সময় জ্যামিতি বাক্স পড়ে গেল। চাদা, কম্পাস এসব ছড়িয়ে পড়ল। চারদিকে। সে বসে বসে এইসব তুলছে এবং চোখ মুছছে।
একটা রিকশাওয়ালাকে পাওয়া গেল–সে দশ টাকা ভাড়া চায়। মেয়েটার সঙ্গে বোধ হয় দশ টাকা নেই। সে অনুনয়-বিনয় করছে সাত টাকায় যাবার জন্যে।
হীরুর এতক্ষণ বেশ মজাই লাগিছিল এখন খানিকটা খারাপ লাগল–সব এসএসসি পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কয়েকজন করে আত্মীয়-স্বজন থাকে। ও যাচ্ছে একা এবং সঙ্গে দশ টাকাও নেই।
হীরু তখন এগিয়ে গেল। গলার স্বর যথাসম্ভব গভীর করে বলল, খুকী আমার কাছ থেকে দশটা টাকা নিয়ে নাও। এক সময় দিয়ে দিলেই হবে। আমি এই দিকেই থাকি।
মেয়েটি শীতল চোখে খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, আমার কাছে টাকা আছে। আর যদি নাও থাকে। আপনার কাছ থেকে নেব কেন?
হীরু হতভম্ব। নিজেকে সামলে নিতে সময় লাগল। মেয়েটি বলল, পাঁচ টাকা ভাড়া হয় আমি শুধু শুধু তাকে দশ টাকা দেব কেন?
তা তো বটেই। তবে দেরি হয়ে যাচ্ছে না?
হোক দেরি।
তোমার কোন স্কুলে সিট পড়েছে?
মেয়েটি জবাব না দিয়ে বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে গেল। একটা বাস এসে থেমেছে। বাসে যথেষ্ট ভিড়। বাস স্ট্যান্ডেও অপেক্ষমাণ ছোটখাটো জনতা। মেয়েটি সেই ভিড় কাটিয়ে বাসে উঠে পড়ল।
দূর থেকে হীরু মনে মনে বলল–সাবাস। বলেই তার খেয়াল হল যে তার পকেট ফাঁকা একটা টাকাও নেই। মেয়েটা যদি তখন বলত–দিন দশটা টাকা, তাহলে উপায়টা কি হত?
মেয়েটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হতে বেশি সময় লাগল না। দেখা হলে সে কথা বলে। হীরু ঘুরিয়েফিরিয়ে দু’একটা রোমান্টিক কথাও বলেছে তেমন কোনো রি-অ্যাকশান অবশ্যি তাতে বোঝা যায়নি। এর মধ্যে একটা ডায়ালগ ছিল এ রকম আজ তো তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
মেয়েটি হেসে ফেলল বলেছে–শুধু শুধু মিথ্যা কথা বলেন কেন? যে সুন্দর না তাকে সুন্দর বললে তার খুব খারাপ লাগে . এটা আপনি জানেন?
মেয়েটার এইটাই হচ্ছে একটা সমস্যা। ফটফট করে কথা বলে। বেশি চালাক। মেয়েছেলের বেশি চালাক হওয়া ঠিক না।
হীরু এ্যানাদের বাসার ঠিক সামনের রিকশা থেকে নামল। রিকশায় আসতে আসতে সে ঠিক করে। রেখেছে–এ্যানাদের বসার ঘরের জানালার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কয়েকবার কাশবে। যক্ষ্মারুগীর কাশি না–ভদ্র কাশি। যাতে এ্যানা ভেতর থেকে শুনতে পেয়ে বের হয়ে আসে।
হীরুকে কাশতে হল না। সে দেখল এ্যানা বাসার সামনের দোকান থেকে কি যেন কিনছে। এদের বাড়িতে কোনো কাজের লোক নেই বলে দোকানের টুকটাক বাজার মেয়েদেরই করতে হয়। হীরু এগিয়ে গেল।
এ্যানা আধ কেজি চিনি কিনছে। হীরু গম্ভীর মুখে দোকানদারকে বলল, পাল্লাটা ঠিকমত ধরেন ভাইজান। পাল্লায় ফের আছে? নগদ পয়সায় পারলিক জিনিস কিনবে আর আপনি পারলিককে ঠকাবেন তা তো হয় না।
এ্যানা বলল, নগদ পয়সায় কিনছি না; বাকিতে কিনছি।
বলেই হীরুকে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে চিনির ঠোঙা হাতে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেল। যেন হীরুকে সে চেনে না। যেন হীরু রাস্তার একটা ছেলে। হীরু মনে মনে বলল, হারামজাদী।