তবু আমার এই রক্ত-মাংসে এই ভাবে-ভাবনায় গড়া বীণাটা ওঁরই হাতে বাজতে লাগল। সেই হাতটাকে আমি ঘৃণা করতে চাই এবং এই বীণাটাকে– কিন্তু, বীণা তো বাজল! আর, সেই সুরে যখন আমার দিন রাত্রি ভরে উঠল তখন আমার আর দয়ামায়া রইল না। এই সুরের রসাতলে তুমিও মজো, আর তোমার যা-কিছু আছে সব মজিয়ে দাও, এই কথা আমার শিরার প্রত্যেক কম্পন আমার রক্তের প্রত্যেক ঢেউ আমাকে বলতে লাগল।
এ কথা আর বুঝতে বাকি নেই যে আমার মধ্যে একটা-কিছু আছে যেটা– কী বলব? যার জন্যে মনে হয় আমার মরে যাওয়াই ভালো।
মাস্টারমশায় যখন একটু ফাঁক পান আমার কাছে এসে বসেন। তাঁর একটা শক্তি আছে তিনি মনটাকে এমন একটা শিখরের উপর দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন যেখান খেকে নিজের জীবনের পরিধিটাকে এক মুহূর্তেই বড়ো করে দেখতে পাই– বরাবর যেটাকে সীমা বলে মনে করে এসেছি তখন দেখি সেটা সীমা নয়।
কিন্তু, কী হবে! আমি অমন করে দেখতেই চাই নে। যে নেশায় আমাকে পেয়েছে সেই নেশাটা ছেড়ে যাক এমন ইচ্ছাও যে আমি সত্য করে করতে পারি নে। সংসারের দুঃখ ঘটুক, আমার মধ্যে আমার সত্য পলে পলে কালো হয়ে মরুক, কিন্তু আমার এই নেশা চিরকাল টিঁকে থাক্ এই ইচ্ছা যে কিছুতেই ছাড়াতে পারছি নে। আমার ননদ মুনুর স্বামী যখন মদ খেয়ে মুনুকে মারত, তার পরে মেরে অনুতাপে হাউ হাউ করে কাঁদত, শপথ করে বলত “আর কখনো মদ ছোঁব না’, আবার তার পরদিন সন্ধ্যা বেলাতেই মদ নিয়ে বসত–দেখে আমার সর্বাঙ্গ রাগে ঘৃণায় জ্বলত। আজকে দেখি আমার মদ খাওয়া যে তার চেয়ে ভয়ানক– এ মদ কিনে আনতে হয় না, গ্লাসে ঢালতে হয় না– রক্তের ভিতর থেকে আপনা-আপনি তৈরি হয়ে উঠছে। কী করি! এমনি করেই কি জীবন কাটবে?
এক-একবার চমকে উঠে আপনার দিকে তাকাই আর ভাবি আমি আগাগোড়া একটা দুঃস্বপ্ন, এক সময়ে হঠাৎ দেখতে পাব এ-আমি সত্য নয়। এ যে ভয়ানক অসংলগ্ন, এর যে আগার সঙ্গে গোড়ার মিল নেই, এ যে মায়া-জাদুকরের মতো কালো কলঙ্ককে ইন্দ্রধনুর রঙে রঙে রঙিন করে তুলেছে। এ যে কী হল, কেমন করে হল, কিছুই বুঝতে পারছি নে।
একদিন আমার মেজো জা এসে হেসে বললেন, আমাদের ছোটোরানীর গুণ আছে। অতিথিকে এত যত্ন, সে যে ঘর ছেড়ে এক তিল নড়তে চায় না। আমাদের সময়েও অতিথিশালা ছিল, কিন্তু অতিথির এত বেশি আদর ছিল না; তখন একটা দস্তুর ছিল, স্বামীদেরও যত্ন করতে হত। বেচারা ঠাকুরপো একাল ঘেঁষে জন্মেছে বলেই ফাঁকিতে পড়ে গেছে। ওর উচিত ছিল অতিথি হয়ে এ বাড়িতে আসা, তা হলে কিছুকাল টিঁকতে পারত– এখন বড়ো সন্দেহ। ছোটো রাক্ষুসী, একবার কি তাকিয়ে দেখতেও নেই ওর মুখের ছিরি কিরকম হয়ে গেছে!
এ-সব কথা একদিন আমার মনে লাগতই না, তখন ভাবতুম আমি যে ব্রত নিয়েছি এরা তার মানেই বুঝতে পারে না। তখন আমার চারি দিকে একটা ভাবের আবরু ছিল; তখন ভেবেছিলুম, আমি দেশের জন্য প্রাণ দিচ্ছি, আমার লজ্জা-শরমের দরকার নেই।
কিছুদিন থেকে দেশের কথা বন্ধ হয়ে গেছে। এখনকার আলোচনা মডার্ন্ কালের স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধ এবং অন্য হাজার রকমের কথা। তারই ভিতরে ভিতরে ইংরেজি কবিতা এবং বৈষ্ণব কবিতার আমদানি; সেই-সমস্ত কবিতার মধ্যে এমন একটা সুর লাগানো চলছে যেটা হচ্ছে খুব মোটা তারের সুর। এই সুরের স্বাদ আমার ঘরে আমি এতদিন পাই নি; আমার মনে হতে লাগল, এইটেই পৌরুষের সুর, প্রবলের সুর।
কিন্তু আজ আর কোনো আড়ালই রইল না। কেন যে সন্দীপবাবু দিনের পর দিন বিনা কারণে এমন করে কাটাচ্ছেন, কেনই যে আমি যখন-তখন তাঁর সঙ্গে বিনা প্রয়োজনের আলাপ-আলোচনা করছি, আজ তার কিছুই জবাব দেবার নেই।
তাই আমি সেদিন নিজের উপর, আমার মেজো জায়ের উপর, সমস্ত জগতের ব্যবস্থার উপর খুব রাগ করে বললুম, না, আমি আর বাইরের ঘরে যাব না, মরে গেলেও না।
দু দিন বাইরে গেলুম না। সেই দু দিন প্রথম পরিষ্কার করে বুঝলুম কত দূরে গিয়ে পৌঁচেছি। মনে হল যেন একেবারে জীবনের স্বাদ চলে গেছে। যেমন সমস্তই ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঠেলে ঠেলে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। মনে হল কার জন্যে যেন আমার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত অপেক্ষা করে আছে, যেন সমস্ত গায়ের রক্ত বাইরের দিকে কান পেতে রয়েছে।
খুব বেশি করে কাজ করবার চেষ্টা করলুম। আমার শোবার ঘরের মেজে যথেষ্ট পরিষ্কার ছিল, তবু নিজে দাঁড়িয়ে ঘড়া-ঘড়া জল ঢালিয়ে সাফ করালুম। আলমারির ভিতর জিনিসপত্র একভাবে সাজানো ছিল, সে-সমস্ত বের করে ঝেড়ে-ঝুড়ে বিনা প্রয়োজনে অন্যরকম করে সাজালুম। সেদিন নাইতে আমার বেলা দুটো হয়ে গেল। সেদিন বিকেলে চুল বাঁধা হল না, কোনোমতে এলো চুলটা পাকিয়ে জড়িয়ে নিয়ে ভাঁড়ার-ঘরটা গোছাবার কাজে লোকজনকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলা গেল। দেখি ইতিমধ্যে ভাঁড়ারে চুরি অনেক হয়ে গেছে; তা নিয়ে কাউকে বকতে সাহস হল না, পাছে এ কথা কেউ মনে মনেও জবাব করে “এতদিন তোমার চোখ দুটো ছিল কোথা’।
সেদিন ভূতে পাওয়ার মতো এইরকম গোলমাল করে কাটল। তার পরদিনে বই পড়বার চেষ্টা করলুম। কী পড়লুম কিছুই মনে নেই, কিন্তু এক-একবার দেখি ভুলে অন্যমনস্ক হয়ে বই-হাতে ঘুরতে ঘুরতে অন্তঃপুর থেকে বাইরে যাবার রাস্তার জানলার একটা খড়খড়ি খুলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। সেইখান থেকে আঙিনার উত্তর দিকে আমাদের বাইরের এক-সার ঘর দেখা যায়। তার মধ্যে একটা ঘর মনে হল আমার জীবন-সমুদ্রের ও পারে চলে গিয়েছে। সেখানে আর খেয়া বইবে না। চেয়ে আছি তো চেয়েই আছি! নিজেকে মনে হল আমি যেন পরশুদিনকার আমির ভূতের মতো, সেই-সব জায়গাতেই আছি তবুও নেই।