আলম হাসতে হাসতে বলল–আচ্ছা দেখি এমন কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা যাতে একদিন তোমার প্রচুর টাকা হয়। এখন পান খাওয়াও। পান খেয়ে চলে যাব।
জামান বলল, রাত অনেক হয়েছে। এত রাতে আর যাবি কি? খেকে যা।
নো। থ্যাংক ইউ।
যাবার সময় আলম মানিব্যাগ থেকে দুটা পাঁচ শ টাকার নোট বের করে জামানের দিকে এগিয়ে দিল। জামান বিস্মিত হয়ে বললো, টাকা কিসের?
বাজির টাকা। এক হাজার টাকার একটা বাড়ি ছিল না তোর সঙ্গে? তুই বাজি জিতেছিস।
নায়লা বিশিত হয়ে বললো, কিসের বাজি?
আলম গম্ভীর গলায় বলল, জামানের সঙ্গে বাজি রেখেছিলাম যে তুমি আমাকে বলবে, হোটেলে আপনি কষ্ট করে কেন খাবেন? অল্প কদিন তো আছেন, আমাদের এখানে থাকুন। জামান বলল তুমি কখনো এ জাতীয় কথা বলবে না। এইন ইয়ে এক টাকা বাজি ছিল। তুমি কিছু বললে না। কাজেই জামান বাজি জিল। নে জামান, টাকা রাখ। বাজির টাকা নিতে হয়।
জামান অস্বস্তির সঙ্গে তাকিয়ে আছে।
আলম নোট দুটো টেবিলে নামিয়ে বের হয়ে এল।
বেতনের দিনগুলি
বেতনের দিনগুলি কি আলাদা?
জামানের তাই মনে হয়। মাসের প্রথম দিন অফিসের সবার মুখ হাসি-হাসি থাকে। অফিস কেন্টিনে ভিড় বেশি হয়, গল্প-গুজব বেশি হয়। পান খাওয়া বেশি হয় জামান লক্ষ্য করেছে, ঐদিন সবাই অন্যদিনের চেয়েও ভাল কাপড় পরে আসে। শুধু ক্যাশিয়ার যার হাত দিয়ে টাকা বের হয় তার মুখটা খাকে গম্ভীর। মেজাজ থাকে খিটখিটে। ভাবটা এ রকম যেন তার পকেট থেকে টাকাগুলি যাচ্ছে। এটা কি শুধু তাদের অফিসের ক্যাশিয়ার আবদুল করিমের ক্ষেত্রেই ঘটে, না সব ক্যাশিয়ারের ক্ষেত্রেই কে জানে।
জামান বেতন নিতে এসে দেখে করিম সাহেবের মুখ আজ অন্য দিনের চেয়েও একশ গুণ বেশি গম্ভীর। করিম সাহেব শুকনো গলায় বললেন, টাকা গুনে নিন।
জামান লজ্জিত গলায় বলল, আপনি তো গুনলেন।
কথা বাড়াবেন না। টাকা গুনুন, তারপর বিদায় হন।
নতুন টাকা গুনতেও আনন্দ। এরা কি নতুন টাকায় নেশা ধরাবার মত কিছু দিয়ে দেয়? কিছুক্ষণ টাকাগুলি নাকের সামনে ধরে রাখলে ঝিমঝিম ভাব হয়।
জামান বলল, এক শ টাকা বোধহয় বেশি দিয়েছেন। আবার গুনে দেখি।
আমি কাউকে বেশি দেই না। নিজের সীটে গিয়ে গুনে দেখুন। যান।
জমান টাকা নিয়ে তার ঘরে চলে গেল। তার ঘর ঠিক বলা চলে না। তারা তিনজন এই ঘরটায় বসে। তিনজনের দুজন এখন নেই। তবে জামানের চেয়ারের মুখোমুখি চেয়ারটায় নুরু বসে আছে। নুরু নায়লার ছোট ভাই। গত বছর বি কম দিয়েছিল, পাশ করতে পারেনি। এ বছর আবার দেবার কথা, দিচ্ছে না। প্রিপারেশন না-কি তেমন হয়নি। নুরু হাসিমুখে বলল, দুলাভাই, কি খবর?
খবর ভাল। তুমি এই সকালে ক্ষি ব্যাপার?
সকাল কোথায় দেখলেন? সাড়ে এগারোটা বাজে। দুলা ভাই, চা খাব, সিঙ্গারা খাব। আপনাদের এখানে সিঙ্গারা অসাধারণ বানায়।
বেতনের দিন বেয়ার-টেয়ারা কাউকেই ডেকে পাওয়া যাবে না। জামান নিজেই চা-সিঙ্গারা আনতে উঠে গেল। সে শংকিত বোধ করছে। নুরুর সকালবেলা এসে হাসিমুখে বসে থাকা ভাল লাগছে না। টাকাপয়সার জন্যে এসেছে নাকি? হাক-ভাব। সে রকম। নুরু যতবারই টাকার জন্যে আসে সুন্দর একটা গল্প তৈরি করে আসে। গল্পটা যখন বলে তখন জামান বুঝতে পারে যে মিথ্যা গল্প! তারপরেও শুনতে ভাল লাগে।
সিঙ্গারা অসাধারণ হয়েছে দুলাভাই। আপনাদের ক্যান্টিনের বাবুর্চি মারা গেলে আল্লাহ তাকে বেহেশতের ক্যান্টিনে ভাল বেতনে চাকরি দিয়ে দেবেন।
জামান কিছু বলল না। অস্বস্তি নিয়ে বসে রইল। টাকাটা আবার গুনা দরকার। এক শ টাকা বেশি মনে হচ্ছে। আবার করিম সাহেব বলছেন, ঠিকই আছে। ক্যাশিয়াররা টাকা গুনতে কখনো ভুল করে না।
নুরুর সামনে টাকা বের করা ঠিক হবে না। নুরু চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, দুলাভাই, আপনাদের এই সিঙ্গারাওয়ালাকে কোন একটা টাইটেল দেয়া দরকার–যেমন ধরুন, সিঙ্গারা-সম্রাট বা এই জাতীয় কিছু। সিঙ্গারা-সম্রাট খলিল মিয়া বা এই জাতীয় কিছু শনুতেও ভাল লাগবে। দুলাভাই, লোকটার নাম কি?
নাম জানি না।
বলেন কি? এরকম বিখ্যাত একজন লোক অথচ নাম জানেন না?
এসেছ কি জন্যে বল তো নুরু।
আমার কিছু টাকার দরকার।
কত?
সামান্যই। আপনি যেমন মুখ কালো করে ফেলেছেন সে রকম মুখ কালো করার কিছু না।
সামান্যটা কত?
চল্লিশ হাজার।
ঠাট্টা করছ না-কি নুরু?
না দুলাভাই, ঠাট্টা করছি না। আপনি যেমন সিরিয়াস ধরনের মানুষ, আপনার সঙ্গে কি ঠাট্টা করা যায়? আমার চল্লিশ হাজার টাকাই দরকার। এর এক পয়সা কম হলে চলবে না।
এটা সামান্য টাকা?
আপনার আমার কাছে অনেক বেশি টাকা। কিন্তু এই শহরে কয়েক হাজার লোক আছে যাদের কাছে টাকাটা কিছুই না। লোকজন নাকের সর্দি যেমন ঝেড়ে ফেলে এরা চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকাও সে রকম ঝেড়ে ফেলে।
তুমি তো ওদের কাছে যাওনি নুরু। তুমি এসেছ আমার কাছে।
আপনার চিন্তার কারণ নেই দুলাভাই। চল্লিশ হাজারের পুরোটা আপনাকে দিতে হবে না। আপনি দেকেন অংশবিশেষ। মেজ দুলাভাই দেবেন অংশবিশেষ আর বাকিটা আমি জোগাড় করব। আপনাকে খুব বেশি রকম লাইক করে আপনার ভাগে সামান্য রেখেছি। সেই সামান্যটা হচ্ছে পাঁচ শ। এই বার দয়া করে হাসুন। আপনি চোখ-মুখের যে অবস্থা করে রেখেছেন, মনে হচ্ছে হার্ট এ্যাটাক হচ্ছে। দিন দুলাভাই, পাঁচ শটা টাকা দিন, চলে যাই।