মা আমার জন্যে দোয়া করলেন। নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে অসীম শোকরিয়া জানিয়ে তৃতীয় দিনের দিন মারা গেলেন। মৃত্যুর সময়ও সেই তুচ্ছ কাগজ ছিল তাঁর হাতে।
কিছু কিছু মানুষ বিচিত্র ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসে। আমার ভাগ্য হচ্ছে, আমি কখনো প্রিয়জনদের প্রত্যাশা পুরণ করতে পারব না।
তোমার চেয়ে প্রিয়জন আমার কে আছে? তোমার প্রত্যাশী যে আমি পুরণ করতে পারব না তা আমি ধরে নিয়েই জীবন শুরু করেছি।
তুমি সম্প্রতি যে অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি–সেই অস্থিরতা এবং সেই অস্থিরতার কারণ আমার অজানা নয়। তোমার এই প্রচণ্ড দুঃসময়ে আমি তোমার পাশে দাঁড়াতে পারছি না, কারণ কিছু কিছু যন্ত্রণা আছে যা একা বহন করতে হয়, এবং যন্ত্রণা জয়ের পথ বের করতে হয়।
নায়লা, আমার একমাত্র শুভ কামনা তুমি তোমার যন্ত্রণমুক্তির পথ নিজেই বের করবে। তোমাকে শুধু এই আশ্বাস দিতে চাচ্ছি–তুমি যে পথই বেছে নাও–আমার তাতে সমর্থন থাকবে। সেই পথ যদি আমার জন্যে তীব্র কষ্ট ও গ্লানির হয়–তাতেও ক্ষতি নেই। শুধু তুমি ভাল থেকো তুমি কষ্ট পেও না।
আমি এখানে ভালই আছি। বাবা যে স্কুলে চাকরি করতেন, আমি সেখানেই চাকরি পেয়েছি। বেতন সামান্য। তবে এতেই চলে যাবে। পৃথিবীর কাছে আমার দাবি সামান্যই।
নায়লা, আমি আর শহরে ফিরে যাব না। এখানেই থাকব। আমার জন্যে এই ভাল। অফিস-উফিসের চাকরি আমাকে দিয়ে হবে না।
ঐ রাতে গান শিখতে না পারার যে কষ্টের কথা তুমি বলেছ তাতে আমিও খুব কষ্ট পেয়েছি। তোমার অপূর্ব গানের গলার কথা আমি যে জানি না তা না। বাবুকে ঘুম পাড়ানোর জন্যে তুমি গুন গুন করে গান করতে, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। এই সুরের পেছনে দুঃখজনক ব্যাপারটা জানতাম না। নায়লা, তুমি দুঃখ করো না–তোমার গলায় যে সুর আছে তা পরম করুণাময় দিয়ে পাঠিয়েছেন। এটা তাঁর উপহার। কাজেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি এই সুত্ব রক্ষা করবেন। এটা রক্ষা করার দায়িত্ব তারই।
তুমি ভাল থেকো।
পুনশ্চ : আমি কি চিঠিটা গুছিয়ে লিখতে পারলাম? তুমি বোধহয় জান না–আলম রেশমার কাছে যে কটি চিঠি লিখেছে তার সবই আমার লেখা। ও শুধু কপি করেছে। এটাও একটা মজার কোইনসিডেন্স।
নায়লা সারা বিকেল শুয়ে রইল। সন্ধ্যার আগে আগে পানি গরম করে গোসল করল। তার নতুন ফ্রেঞ্চ শিফন পরতে ইচ্ছা করছে।
জাহানারা বলেন, সন্ধ্যাবেলা এত সাজগোজ করছিস কেন রে?
নায়লা বলল, সাজগোজের কি দেখলে? শাড়িটা বদলাচ্ছি।
সন্ধ্যাবেলা শাড়ি বদলাবি কেন? সন্ধ্যাবেলা শাড়ি বদলানো খুব অলক্ষণ।
হোক অলক্ষণ।
নায়লা শাড়ি বদলাল। বিয়েতে সে রূপার একসেট গয়ন! পেয়েছিল। না ব্যবহারে সেই গয়নায় কালো কালো ছোপ পড়েছে। নায়লা সেই গয়না বের করে তেল দিয়ে ঘসে ঘসে দাগ তুলল। শাদা শাড়ির সঙ্গে রূপার গয়না খুব মানাবে। কাজলদানি ফেলে এসেছে। চোখে কাজল তো দিতেই হবে–কাঠালের পাতা পাওয়া গেলে কাঁঠাল পাতার উল্টো দিকে তেল মাখিয়ে কাজল বানানো যেত।
জাহানারা বললেন, নায়লা, তুই কি কোথাও যাচ্ছিস?
হুঁ।
কোথায়?
হোটেল শেরাটনে। তুমি আমাকে কাজল বানিয়ে দাও তো মা, কাজল পরব।
তোর ভঙ্গি যেন কেমন কেমন লাগছে! ভর সন্ধ্যায় তুই কোথায় যাবি?
নায়লা হাসল।
মায়াময় কোন ছায়াবীথির দিকে
আলম অবাক হয়ে বলল, আরে তুমি! নায়লা হাসতে হাসতে বলল, আমাকে কেমন লাগছে আগে বলুন।
সুন্দর! অসম্ভব সুন্দর!
শাদী শাড়ি পরে আছি, বিধবার মত লাগছে না তো?
তোমাকে শ্বেতপরীর মত লাগছে। এত সুন্দর সাজ করা কোন মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি।
আর কোনদিন দেখবেনও না। আমি চলে যাচ্ছি।
কোথায় চলে যাচ্ছ?
আপনার বন্ধুর কাছে। চাকরি-টাকরি গিয়ে ওর একাকার অবস্থা। দেশের বাড়ি চলে গেছে। ওখানে গ্রামের স্কুলে মাস্টারি করবে।
আলম বিস্মিত হয়ে বলল, তুমি সেখানে যাচ্ছ?
হুঁ।
জঙ্গলে পড়ে থাকবে?
নায়লা হাসতে হাসতে বলল, কি আর করা আমি আপনার কাছে বিশেষ কাজে এসেছি।
কাজটা কি?
আপনি আমাকে ঢাকা রেল স্টেশনে পৌঁছে দেবেন এবং একটা ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কেটে দেবেন। আমার কাছে টাকা নেই।
তুমি একা একা যাবে?
হ্যাঁ, একা একা যাব এবং শেষ রাতে আপনার বন্ধুকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে চমকে দেব।
বল কি?
আপনাকে আরেকটা কাজ করতে হবে। আমার মার বাসায় গিয়ে আমি যে নেত্রকোনা যাচ্ছি এই খবরটা দিতে হবে। মা কিছু জানেন না।
অবশ্যই উনাকে আমি খবর দেব।
আর নুরুকে বলবেন সে যেন বাবুকে এবং আমাদের জিনিসপত্র নেত্রকোনায় পৌঁছে দেয়।
আচ্ছা। আর কি আদেশ?
আদেশ হচ্ছে, দেরি না করে অরুনাকে বিয়ে করুন। এরকম মেয়ে পাবেন না।
আদেশ পালিত হবে।
তাহলে চলুন রওনা হওয়া যাক। ট্রেনের বেশি দেরি নেই।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। প্রথম শ্রেণীর একটা কামরায় নায়লা একা। সে জানালা দিয়ে মুখ বের করে আছে।
আলম বলল, একা একা যেক্তে ভয় লাগছে না তো?
নায়লা বলল, একা কোথায়? ট্রেন ভরতি যাত্রি।
নায়লা হাসল। আলম চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে আসছে। এক সময় সে থমকে পঁড়িয়ে গিয়ে বলল, নায়ল! ভাবী, তুমি ভাল থেকো।
অনেক দিন পর আলম তাকে ভাবী ডাক। নায়লা হাত নাড়ছে। তার শাদা শাড়ি উড়ছে পত পত করে।
নায়লার মনে হচ্ছে, সমস্ত দুঃসময়, সমস্তু গ্লানি ও হতাশা পেছনে ফেলে এই ট্রেন তাকে নতুন কোথাও নিয়ে যাচ্ছে–ট্রেন যেন এগুচ্ছে মায়াময় কোন ছায়াবীথির দিকে।